প্রত্যক্ষণের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

admin

ভূমিকা :

আমরা কোন না কোন পরিবেশে বাস করি এবং এ পরিবেশকে আমরা জানি। একথা সত্য যে, পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বহুলাংশে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবেদনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একথাও সমপরিমাণে সত্য, পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ইন্দ্রিয় সংবেদন ছাড়াও অনেক কিছু আছে। আমরা যখন কোন বস্তু দেখি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে কতকগুলো আলোক সংবেদন পাই। কিন্তু আমরা এতেই তুষ্ট থাকি না। আমরা বলি যে, একটি বস্তু দেখা যাচ্ছে এবং সে বস্তুটির নামকরণও করি। বস্তুটির যাবতীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য আমাদের ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়ে না। এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষণের সাহায্যে সরবরাহ করা হয়।

প্রত্যক্ষণের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।


প্রত্যক্ষণের স্বরূপ বা প্রকৃতি :

প্রত্যক্ষণের স্বরূপ নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল :


১. প্রত্যক্ষণ একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া : প্রত্যক্ষণ হল জীবের পক্ষ থেকে সক্রিয় একটি প্রক্রিয়া। বাহ্য পরিবেশের পরিবর্তনের জন্যই জীব ক্রিয়া করে । বাহ্য জগতে যদি কোন পরিবর্তন না ঘটতো, তবে প্রত্যক্ষণ করার প্রশ্নই উঠতো না ।


২. প্রত্যক্ষণ নির্বাচনমূলক : যদিও বাহ্য জগত আমাদের প্রত্যক্ষণকে প্রভাবিত করে, তবুও বাহ্য জগতে যা কিছু ঘটে তার সবকিছুই আমরা প্রত্যক্ষণ করি না। বাহ্য জগতের অসংখ্য উদ্দীপকের মধ্যে আমরা এক বা একাধিক উদ্দীপককে নির্বাচন করে নিই এবং তাকেই প্রত্যক্ষণ করি। এ নির্বাচন নির্ভর করে আমাদের আগ্রহ (interest), মনোযোগ (attention), আবেগ (Emotion) প্রভৃতির উপর। বাহ্য জগতের অসংখ্য উদ্দীপকের মধ্যে যেসব উদ্দীপক আমাদের আগ্রহ মেটাতে সমর্থ কিংবা আমাদের আবেগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তাদেরই শুধু আমরা প্রত্যক্ষণ করি। অন্যান্য জিনিসের প্রতি লক্ষ্যই করা যায় না। সুতরাং, প্রত্যক্ষণ হল নির্বাচনমূলক ।


৩. প্রত্যক্ষণ একটি গঠন প্রক্রিয়া:

বাহ্য জগতের বস্তুগুলো যেমনভাবে বিন্যস্ত থাকে প্রত্যক্ষণক্রিয়ায় সেগুলো প্রত্যক্ষণকারীর দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা নতুনভাবে বিন্যস্ত হয় এবং একটি নতুন গঠনরূপ (Definite pattern or figure) পেয়ে থাকে। প্রত্যক্ষণ যে একটি গঠন প্রক্রিয়া, এ কথার উপর গেস্টাল্টবাদীরা সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। একই ধরনের উপাদান বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিভিন্নরূপে প্রত্যক্ষীভূত হতে পারে। সাধারণত, যেসব বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য থাকে প্রত্যক্ষণকারী সেসব বস্তুকে একত্রে প্রত্যক্ষণ করেন।


৪. প্রত্যক্ষণ হল সংশ্লেষক প্রক্রিয়া : যখন আমরা কোন একটি বস্তুকে প্রত্যক্ষণ করি, তখন তাকে একটি 'একক' unit) বা 'সমগ্র' (whole) হিসেবে প্রত্যক্ষণ করি। সেটি যে অংশ বিশেষের সমন্বয় সেভাবে প্রত্যক্ষণ করি না। একটি গাছকে প্রত্যক্ষণ করার সময় আমরা গাছটিকে একটি বস্তু হিসেবেই প্রত্যক্ষণ করি। গাছটি যে শাখাপ্রশাখা, পত্র ও ফুলের সমন্বয় তা মনে করে প্রত্যক্ষণ করি না।


৫. প্রত্যক্ষণ উপস্থাপনমূলক পুনরুজ্জীবনমূলক প্রক্রিয়া : প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়ার দু'টি দিক আছে। প্রথম দিকটি হল উপস্থাপনমূলক, বর্তমানে যে সংবেদনটি আমার কাছে উপস্থিত হচ্ছে। যেমন- আমার বস্তুর কন্ঠস্বর। দ্বিতীয় দিকটি হল, পুনরুজ্জীবনমূলক অর্থাৎ, বর্তমান সংবেদনটি অতীতলব্ধ অন্যান্য যেসব সংবেদনগুলোকে আমার মনে জাগিয়ে তুলেছে। যেমন- আমার বন্ধুর কন্ঠস্বর, তার সাথে সংযুক্ত যে দৃষ্টিগত এবং স্পষ্টগত সংবেদন আছে। সেগুলোকে আমার মনে পুনরুজ্জীবিত করছে।


৬. প্রত্যক্ষণ হল জানা ও চেনার যুক্তি প্রক্রিয়া : পূর্বোক্ত উদাহরণটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমি জেনেছি যে এটি একটি কন্ঠস্বর। তারপর সে কণ্ঠস্বরটিকে আমার বন্ধুর কণ্ঠস্বর বলে চিনেছি। জানা ও চেনা উভয় প্রক্রিয়া একত্রে যুক্ত হলেই সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ সম্ভব হয় ।


৭. প্রত্যক্ষণ হল বর্তমানের সাথে অতীতের, নতুনের সাথে পুরাতনের সংমিশ্রণ : যে সংবেদনটি আমি বর্তমানে লাভ করেছি, সেটি আমার কাছে নতুন। সে সংবেদনটি অতীতে লব্ধ পুরাতন এবং পরিচিত সংবেদনগুলোকে আমার মনে জাগিয়ে তুলেছে এবং তার সাথে সংযুক্ত হচ্ছে, সে কারণেই মনোবিজ্ঞানী Angell বলেছেন যে, 'প্রত্যক্ষণ হল সংশ্লেষাত্মক অভিজ্ঞতা এবং পুরাতনের সাথে নতুনের সংযোগ সংশ্লেষণের প্রয়োজনীয় অংশ' ।


৮. প্রত্যক্ষণ প্রত্যক্ষণকারীর অভিজ্ঞতা, শিক্ষণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের উপর নির্ভরশীল : প্রত্যক্ষণকারীর অভিজ্ঞতা, শিক্ষণ, পরিবেশ, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক প্রস্তুতি, মনোভাব (attitude) ও সমাজের প্রভাবের উপর প্রত্যক্ষণ নির্ভরশীল। প্রত্যক্ষণকারী ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবেদনের কিরূপ ব্যাখ্যা করবেন তা এসব বিষয় দ্বারাই নির্ধারিত হয়। প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। অতীতের অভিজ্ঞতা যতই ব্যাপক ও বৈচিত্রপূর্ণ হয়, বর্তমানের বিষয়গুলোর প্রত্যক্ষণও ততই পূর্ণাঙ্গ হয় ।


৯. পূর্ণাঙ্গ প্রত্যক্ষণ অভ্যাস সাপেক্ষ : পূর্ণাঙ্গ প্রত্যক্ষণ অভ্যাস সাপেক্ষ ব্যাপার। অবশ্য অভ্যাস বলতে এখানে অবগতিরূপ মানসিক প্রক্রিয়ার অভ্যাসের কথা বলা হচ্ছে। যেমন- কোকিলের ডাক শুনতে যে অভ্যস্ত, সে ব্যক্তি কেবলমাত্র স্বরটি শুনেই বুঝতে পারে কি রকমের পাখি ডাকছে।


১০. প্রত্যক্ষণের দু'টি দিক : প্রত্যক্ষণের দু'টি দিক আছে, একটি বাইরের দিক, আরেকটি মনের দিক। বাইরের দিকটি হল বস্তুগত দিক বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ দিক (Objective), অপরটি হল, মনোগত বা ব্যক্তিসাপেক্ষ দিক (Subjective) মনোযোগ, প্রত্যাশা এবং কামনা হল প্রত্যক্ষণের ব্যক্তিসাপেক্ষ দিক, যা প্রত্যক্ষণের উপর অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে। পূর্ব থেকে মনোযোগী এবং প্রত্যাশী হয়ে থাকার ফলে এবং বস্তুটির জন্য কামনা থাকায় আমাদের প্রত্যক্ষণ কার্যটি অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠে আবার এ মনোগত দিকের সাহয্যেই আমাদের ভ্রমাত্মক প্রত্যক্ষণের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়। যেমন- সন্ধ্যালোকে খড়ের গাদাকে বাড়ি বলে বা দূরবর্তী বজ্রানির্ঘোষকে রেলগাড়ির গুড়গুড় শব্দ বলে ভ্রমপ্রত্যক্ষণ হয়। প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিসাপেক্ষ উপাদানগুলো (Subjective elements) কোন মতেই উপেক্ষণীয় নয়।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, প্রত্যক্ষণ প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে মানুষ যে কোন বিষয়ের গভীরে পৌছাতে পারে। তাই প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে অন্য কোন বিষয় ক্রীয়াশীল না হওয়াই উত্তম। কারণ প্রত্যক্ষণের সময় যদি মন অন্যদিকে ধাবিত হয় তাহলে প্রত্যক্ষণ সঠিক না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রত্যক্ষণ অত্যন্ত সুচারু হওয়া দরকার।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!