ভূমিকা:
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যে ক'জন দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁর মধ্যে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি হলেন অন্যতম। রাষ্ট্রচিন্তায় বিশেষ অবদানের জন্য তাঁতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাতে মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে আধুনিক যুগের আলোর জগতে নিয়ে আসেন। তাঁর সম্পর্কে অনেক ভাষ্যকার বলেন, "যদি ষোড়শ শতাব্দীতে ম্যাকিয়াভেলির আবির্ভাব না হতো, তবে হয়তো আধুনিক চিন্তার জগত আরও দীর্ঘদিন বিলম্ব করত।" তাই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত হিসেবে তাকে অভিহিত করা হয়।
ম্যাকিয়াভেলিবাদ কি :
ম্যাকিয়াভেলিই হলেন সর্বপ্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, যিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের উপায় ও শাসনের কলাকৌশল সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি সমসাময়িক ইতালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি অবলোকন। করে রাজাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য অনেকগুলো বাস্তব ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক উপদেশ দান করেন। এটাই রাজনৈতিক চিন্তাজগতে 'ম্যাকিয়াভেলিবাদ' নামে পরিচিত। তাঁর নিজের ভাষায়, 'End justifies the means.” অর্থাৎ উদ্দেশ্যই উপায়কে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করে।
ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক যুগের প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলার কারণ:
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে কেন আধুনিক যুগের প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলা হয় নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি : ম্যাকিয়াভেলিতে আধুনিক যুগের প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলার অন্যতম একটি কারণ হলো তার রাজনৈতিক পদ্ধতি। রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে তিনি এমন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন যাকে তিনি 'Emprical Method বা 'প্রয়োগবান পদ্ধতি' বলে উল্লেখ করেছেন। এ পদ্ধতির মূলমন্ত্র হলো যুদ্ধভিত্তিক চিন্তা, ধর্ম ও নীতিবোধ বিবর্জিত পদ্ধতি।
২. রাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা : ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করেন। তিনিই | সর্বপ্রথম ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান এবং অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মাধ্যমে একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. জাতীয় রাষ্ট্রের প্রবক্তা: তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দার্শনিক যিনি আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের প্রবক্তা। তাঁর মতবাদ আজ সর্বজন স্বীকৃত মতবাদ। মধ্যযুগে এ মতবাদ ছিল অজ্ঞাত। মধ্যযুগের চিন্তাধারার মধ্যমনি ভাবা হতো বিশ্বজনীনতাকে। এ মতবাদকে তিনি গড়িয়ে দিয়ে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে বলেন।
৪. কূটনীতির প্রতিষ্ঠা : ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম দার্শনিক যিনি | হাতের প্রয়োজনে কুনোতক ফয়সালার কথা উল্লেখ করেছেন। নোতক আশ্রয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ”নরপতিকে সিংহের ন্যায় রেজা, মৃগালের ন্যায় ধূর্ত হতে হবে। সঠিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো নীতি গ্রহণই উৎকৃষ্ট।"
৫. শাসকের চরিত্র : শাসকের চরিত্র সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলি চিত্র তুলে ধরেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর “The Prince' নামক গ্রন্থে সম্পর্কে বলেন, শাসকের চরিত্রের দুটি
বৈশিষ্ট্য থাকবে। যথা-
(i) শাসক হবেন অসীম শক্তিশালী ও তিনি হবেন তীক্ষ্ণ ও ফুটবুদ্ধিসম্পন্ন।
(ii) তাঁর কথায় শাসক হবেন, “সিংহের মতো বলবান আর মৃগালের মত ধূর্ত।"
৬. ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র : ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন যে, একমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রই মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারে। তাই মধ্য যুগের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার বিরোধিতা করে আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করতে প্রতি তিনি জোর দেন।
৭. আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা : নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিই একমাত্র রাজনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রে আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র আইনের শাসনই শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত নির্মাণে সহায়তা করতে পারে।
৮. বিশ্লেষণধর্মী মতামত : ম্যাকিয়াভেলি ইতালির তৎকালীন সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত নিকট থেকে বাস্তবভাবে অনুধাবন করেন। এবং এর পটভূমিতে পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় সংহতির বিষয় তার কাছে প্রধান সমস্যা বলে মনে হয়েছে। তাঁর মতে, “রাষ্ট্র যে কোনো মূল্যে তার শক্তি বৃদ্ধি করে যাবে।”
৯. জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন : ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম আধুনিক যুগে জাতীয় সৈন্যের ধারণা নিয়ে আসেন। তিনি ভাড়াটিয়া সৈন্যের পরিবর্তে শক্তিশালী জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করেন।
১০. আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা : ম্যাকিয়াভেলি তাঁর লেখায় সরাসরি জাতীয়তাবাদের কথা উল্লেখ না করলেও তিনি বই প্রতিষ্ঠায় ও ঐক্যবদ্ধতার যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন তা অধ্যয়নে অনুধাবন করা যায় যে, তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সচেতনভাবে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জগতে ম্যাকিয়াভেলি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন তাঁর বিভিন্ন ধরনের মতবাদের জন্য। তিনি মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে সমগ্র ইউরোপ তথা ইতালিকে আধুনিক যুগের আলোর পথে নিয়ে আসেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য তাঁকে আধুনিক যুগের প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।