মনোবিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো বর্ণনা কর।

admin

ভূমিকা :

আত্মসম্পর্কীয় ধারণা নিয়ে মনোবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে মনোবিজ্ঞান একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেছে। সময়ের পরিবর্তন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে উন্মোচিত হয়েছে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক, প্রসারিত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্র। শিক্ষা, শিল্প বাণিজ্য, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ইঞ্জিনিয়ারিং, যুদ্ধ, দেশরক্ষা, চিকিৎসা শিশুপালন,  অপরাধ তত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের একচ্ছত্র আধিপত্য অব্যাহত রয়েছে। এভাবে জীবন পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উদ্ভব হয়েছে। ক্ষেত্র বিষয়ের বিভিন্নতা অনুযায়ী মনোবিজ্ঞানকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে ।


মনোবিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো বর্ণনা কর।


মনোবিজ্ঞানের শাখাসমূহ :

 নিম্নে মনোবিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

 ১. সাধারণ মনোবিজ্ঞান :

মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়সমূহ মূলত সাধারণ মনোবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য বিষয়। সাধারণ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যা আলোচনা করে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করে। তাই সাধারণ মনোবিজ্ঞানের সকল শাখার সম্মিলিত রূপ বা কেন্দ্রীয় সমন্বয় কেন্দ্র বলা যেতে পারে। আচরণ ও মানসিক কার্যাবলি সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলো, যেমন- প্রেষণা, শিক্ষণ, স্মৃতিবিস্মৃতি, প্রত্যক্ষণ, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, চিন্তন, আবেগ প্রভৃতি সাধারণ মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত।


2. পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান :

পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। মনোবিজ্ঞানের এ শাখায় পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে উপাত্ত সংগ্রহ করে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত অবস্থায় সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষণ পাত্রের উপর উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবের আচরণের মৌলিক কারণ খুঁজে বের করা হয়। আচরণ সম্পর্কিত প্রায় সকল তত্ত্বই পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ততথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ।


৩. ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞান :

মানসিক রোগের চিকিৎসার ইতিহাস বেশ পুরাতন। প্রাচীনকালে মানসিক রোগীকে স্বাভাবিক মানুষ থেকে আলাদাভাবে দেখা হতো। মনে করা হতো তাদের উপর ডাইনি বা অশারীরী শক্তি বা অপদেবতা ভর করেছে। বর্তমানে ঐসব প্রাচীন ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। অস্বভাবী আচরণের গতিপ্রকৃতি ও তার ব্যাখ্যা, মানসিক রোগের লক্ষণ, কারণ ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি প্রভৃতি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয়। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী প্রথমে রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করে তার কারণ অনুসন্ধান করতে সচেষ্ট হন। তারপর রোগীর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন অভীক্ষা প্রয়োগ করে থাকেন। রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীগণ গ্রহণ করে থাকেন।


৪. শিক্ষণীয় মনোবিজ্ঞান :

শিক্ষা মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। মনোবিজ্ঞানের এ শাখায় মানুষের শিক্ষা সম্পর্কিত আচরণের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং এগুলোর সমাধানে মনোবিজ্ঞানের মূলনীতিসমূহ কিভাবে প্রয়োগ করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত মানুষের সব ধরনের আচরণই শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ।


৫. শিল্প মনোবিজ্ঞান :

মনোবিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলিত শাখা হল শিল্প মনোবিজ্ঞান। শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করার লক্ষ্যে শিল্প মনোবিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটেছে। শিল্পকারখানায় শ্রমিক নিয়োগ, কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী উপযুক্ত লোক নির্বাচন, তাদের প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও মূল্যায়ন প্রভৃতি শিল্প মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে কর্মচারীদের দক্ষতা, মনোবল ও কর্মসন্তুষ্টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই কর্মচারীর দক্ষতা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং কর্মে সন্তুষ্টি বিধান শিল্প মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য।


৬. উন্নয়ন মনোবিজ্ঞান :

বিকাশ মনোবিজ্ঞান হল মনোবিজ্ঞানের সে শাখা, যেখানে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সেসব পরিবর্তনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মনোবিজ্ঞানের এ শাখা শুধু বয়স অনুযায়ী আচরণের বিবরণ প্রদান করে তা নয়, এটি বিভিন্ন বয়সে ব্যক্তিভেদে আচরণে যে পার্থক্য দেখা দেয় তার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।


৭. শিশু মনোবিজ্ঞান :

শিশু মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। এ শাখা শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করে। মাতৃগর্ভে থাকালীন সময় থেকে শুরু করে যৌন পরিপক্বতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত শিশু মনোবিজ্ঞানের বিস্তৃতি। বয়স বাড়ার সাথে শিশুর যে শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে এবং শারীরিক বৃদ্ধির ফলে তার আচরণে কি পরিবর্তন ঘটে তা শিশু মনোবিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয়



৮. সামাজিক মনোবিজ্ঞান :

মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজে বসবাসের উপযোগী আচরণ করতে হয়। মানুষের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। কি প্রক্রিয়ায় শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে, সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো কিভাবে কাজ করে কিভাবে মনোভাব গড়ে আচরণই সমাজ মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু। সমাজে বাস করার সময়ে একের সাথে অন্যের ভাব বিনিময় হয়, পারস্পরিক উঠে। মনোভাব কিভাবে পরিবর্তিত হয়, গুজব কিভাবে এবং কেন ছড়ায়, জনমত কিভাবে গঠিত হয় এবং কিভাবে পরিমাপ করা যায়, সামাজিক পরিবেশ কিভাবে ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে, পূর্ব সংস্কার, অপরাধ এবং অপরাধ দমনের উপায় প্রভৃতি সমাজ মনোবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।


৯. শারীরিক মনোবিজ্ঞান :

উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেওয়া জীবের বৈশিষ্ট্য। উদ্দীপকের প্রতি সাড়া বা প্রতিক্রিয়াই হল আচরণ আর আচরণের মূলে রয়েছে শারীরিক ভিত্তি। কোন আচরণের মূলে কোন শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িত তা physiological  আলোচনা করে।


১০. নির্দেশনা ও পরামর্শ মনোবিজ্ঞান :

দৈনন্দিন জীবনে মানুষ হাজারও সমস্যার সম্মুখীন হয়। সঠিকভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারলে দেখা দেয় হতাশা। তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। মৃদু আচরণ সমস্যার সমাধানের নিমিতে গড়ে উঠেছে Counseling and guidance psychology. মৃদু আচরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি যখন কোন সঠি

সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে Counseling and guidance psychologist এর দ্বারস্থ হতে হয় । Counseling and guidance psychologist ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত, পেশাগত অথবা সামাজিক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন ।


১১. প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান : মনোবিজ্ঞানের আরেকটি ফলিত শাখা হল Engineering psychology এ শাখাটি Human Engineering নামেও পরিচিত। এ শাখার বিকাশ ঘটেছে বলতে গেলে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হতে। প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান হ মূলত মনোবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞানের সমন্বিত কর্মক্ষেত্র। এর লক্ষ্য হল যন্ত্রকে মানুষের উপযোগী করে তৈরি করা। অর্থাৎ, য পরিকল্পনা এবং এ যন্ত্র পরিচালনার জন্য ব্যক্তি বিশেষের উপযোগিতাই হল এ শাখার প্রধান আলোচ্যবিষয় ।


১২. অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান :

Abnormal psychology মানুষের অস্বভাবী আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বর্ণনা করে এবং কোন বিশেষ নীতির উপর ভিত্তি করে এসব আচরণকে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। কি কারণে অস্বভাবী আচরণের উত্তর ঘটে এবং অস্বভাবী আচরণের শারীরবৃত্তীয়, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ Abnormal psychology এর অন্তর্ভুক্ত।


১৩. অনুমাণ মনোবিজ্ঞান :

মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু ক্ষমতা আছে। আমরা চিন্তা করতে পারি, সমস্যা সমাধান করতে পারি Decision নিতে পারি, যা অন্য কোন প্রাণী করতে পারে না। এগুলোকে এক কথায় বলা হয় higher mental process. এ Higher mental process সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা করে তাকে Cognitive psychology বলে।


১৪. মিশ্র সংস্কৃতি মনোবিজ্ঞান :

প্রত্যেকটি দেশেই অনেক রকম সমাজ আছে এবং এক সমাজের সংস্কৃতি অন্য সমাজের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। এক সমাজের সংস্কৃতি অন্য সমাজের সংস্কৃতিকে বা এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতিকে যখন প্রভাবিত করে তখন তাকে Cross-cultural psychology বলে।


১৫. পরিবেশ মনোবিজ্ঞান :

আমরা কিভাবে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যতা তৈরি করব, কোন ধরনের পরিবেশ আমাদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য উপযোগী, কোন ধরনের পরিবেশ আমাদের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে, কিভাবে পরিবেশকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলা যায় ইত্যাদি বিষয় Environmental psychology এর অন্তর্ভুক্ত।


১৬. ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞান :

কোন দু'টি ব্যক্তি, এক রকম নয়। একেক জনের ব্যক্তিত্ব একেক ধরনের। যেমন- কারও মধ্যে সততা আছে, কারও মধ্যে নেই। Personality আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছি। এভাবে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের Personality নিয়ে Personality psychology আলোচনা করে।


১৭. আদালত মনোবিজ্ঞান :

এটি মনোবিজ্ঞানের একটি নতুন পন্থা। আইনগত দিক নিয়ে এটি আলোচনা করে। যদি কোন ব্যক্তি আসামি হওয়ার পর পাগলের অভিনয় করে সেক্ষেত্রে Forensic psychologist এদের উপর পরীক্ষা করে দেখেন যে, ব্যক্তি সত্যিকারের পাগল কি না।


১৮. স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞান :

এটিও মনোবিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা। এটি Psychological factors এবং Physical diseases নিয়ে আলোচনা করে। যেমন- কারও সামনে পরীক্ষা, কিন্তু বাড়ি থেকে টাকা পাঠাচ্ছে না, হলে সিট পাওয়া যাচ্ছে না, এভাবে একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন আমাদের শরীরে কিছু পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়। যেমন- মুখ শুকিয়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায় ইত্যাদি ।


১৯. নারী মনোবিজ্ঞান :

পুরুষ এবং মেয়েরা সবদিক দিয়ে সমান নয়। এদের মধ্যে গঠনগত, আবেগিক এবং ব্যক্তিত্বগত দিব দিয়ে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। Psychology of woman মেয়েদের আবেগ, ব্যক্তিত্ব, গঠনগত দিক প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচন করে থাকে ।


২০. ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান :

একজন ক্রীড়াবিদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, খেলার মান উন্নয়নে তার মনোবল কেমন থাক উচিত, প্রতিপক্ষের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে Sports psychology আলোচনা করে ।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের বিচরণ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানের পরিধি, শাখাপ্রশাখা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, এ জগতের যা কিছু মানুষের সাথে সম্বন্ধযুক্ত তার সবই মনোবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!