সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যকার পার্থক্যগুলো লিখ।

admin

ভূমিকা :

আমরা কোন না কোন পরিবেশে বাস করি এবং এ পরিবেশকে আমরা জানি। একথা সত্য যে, পরিবেশ আমাদের জ্ঞান বহুলাংশে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবেদনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একথাও সমপরিমাণে সত্য, পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ইন্দ্রিয় সংবেদন ছাড়াও অনেক কিছু আছে। আমরা যখন কোন বস্তু দেখি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে কতকগুলো আলোক সংবেদন পাই। কিন্তু আমরা এতেই তুষ্ট থাকি না। আমরা বলি যে, একটি বস্তু দেখা যাচ্ছে এবং সে বস্তুটির নামকরণও করি। বস্তুটির যাবতীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য আমাদের ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়ে না। এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষণের সাহায্যে সরবরাহ করা হয়।


সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যকার পার্থক্যগুলো লিখ

সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য :

সংবেদন হল জ্ঞানের সরলতম উপাদান। উদ্দীপনার প্রাথমিক চেতনা বা সাড়া। আর সংবেদনের অর্থবোধ বা ব্যাখ্যাই হল প্রত্যক্ষণ। প্রত্যক্ষণ হল সংবেদন ও প্রতিক্রিয়া এ দু'য়ের মধ্যবর্তী একটি মানসিক প্রক্রিয়া। কখন সংবেদন শেষ হয় এবং প্রত্যক্ষণ শুরু হয় যে সেটা পরিষ্কার করে বলা যায় না। তবুও মনোবিজ্ঞানীগণ সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন।


নিচে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ আলোচনা করা হল :


১. সংবেদন হল উদ্দীপনার প্রাথমিক অনুভূতি এবং প্রত্যক্ষণ হল সংবেদনের অর্থবহ ব্যাখ্যা।


২. সংবেদন একটি প্রান্তীয় প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া। বাইরের জগতের উদ্দীপকগুলো ইন্দ্রিয়সমূহকে আঘাত করলে উদ্দীপনাসমূহ মস্তিষ্কের সংবেদন কেন্দ্রে পৌঁছে এবং উদ্দীপক সম্পর্কে প্রাণী প্রাথমিক অনুভূতি বা সংবেদন করে। কাজেই সংবেদন একটি প্রান্তীয় প্রক্রিয়া। প্রত্যক্ষণের সময় এগুলো ছাড়াও মস্তিষ্কের সংযোগ কেন্দ্র সক্রিয় হয়। সুতরাং, প্রত্যক্ষণ একটি কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া ।


৩. সংবেদন হল কেবলমাত্র উপস্থাপনমূলক এবং প্রত্যক্ষণ হল একাধারে উপস্থাপনমূলক ও পুনরুজ্জীবনমূলক প্রক্রিয়া। সংবেদনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপককে মস্তিষ্কের একটি অংশে উপস্থিত করা হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষণে উদ্দীপকের উপস্থাপন ছাড়াও উদ্দীপকটিকে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে তোলা হয়।


৪. সংবেদন অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ অপেক্ষাকৃত সক্রিয় প্রক্রিয়া। বাইরের জগতের বিভিন্ন ঘটনা ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে এলে সংবেদন সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, সংবেদন একটি নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়া। তার প্রত্যক্ষণের সময় ব্যক্তি বিভিন্ন উদ্দীপনার মধ্যে থেকে মাত্র দুই একটি উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকে। এরূপ মনোযোগ হল প্রত্যক্ষণের একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া।


৫. সংবেদন একটি সরল প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। সংবেদনের সময় আমরা কোন বস্তু সম্পর্কে একটি প্রাথমিক অনুভূতি লাভ করে থাকি। কিন্তু প্রত্যক্ষণের সময় ঐ বস্তু সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করে থাকি।


৬. সংবেদন একটি অসংগঠিত প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া। এক বা একাধিক উদ্দীপক থেকে সাময়িক উত্তেজনা যখন মস্তিষ্কে পৌঁছে তখন সেগুলো অসংগঠিত অবস্থায় থাকে। এতে বস্তু সম্পর্কে একটি পূর্ণরূপ পাওয়া যায় না। মস্তিষ্ক সংবেদনযুক্ত বিভিন্ন অসংগঠিত উদ্দীপক সংগঠিত করে থাকে। সংবেদনের এরূপ সংগঠনকে প্রত্যক্ষণ বলা হয়। সুতরাং সংবেদন হল একটি অসংগঠিত প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি সংগঠিত ও সুসমঞ্জস প্রক্রিয়া।


৭. সংবেদন শিক্ষার্জিত প্রক্রিয়া নয়। কিন্তু প্রত্যক্ষণ শিক্ষালব্ধ প্ৰক্ৰিয়া। সংবেদন দৃষ্টির জন্য শিক্ষণের কোন ভূমিকা নেই। ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গুলো ভালো থাকলে সংবেদন ঘটবে। কিন্তু প্রত্যক্ষণ সম্পূর্ণভাবে শিক্ষণ দ্বারা প্রভাবিত ।


৮. সংবেদন প্রেষণা এবং আশা-আকাঙ্খার প্রভাবমুক্ত। ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, মনোভাব, আবেগ, প্রেষণা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ শর্তাবলি দ্বারা সংবেদন প্রভাবিত হয় না। কিন্তু এসব শর্তাবলি দ্বারা প্রত্যক্ষণ প্রভাবিত হয়।


৯. মনোবিজ্ঞানী Woodworth বলেছেন, সংবেদন হল উদ্দীপকের প্রতি প্রথম প্রতিক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ হল উদ্দীপকের দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া।


১০. সংবেদনে উদ্দীপনার অর্থ জানা যায় না। কিন্তু প্রত্যক্ষণে উদ্দীপনার অর্থ জানা যায়।


উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। এরা আসলে একই লম্বা দিগন্তের দু'টি বিন্দু। প্রত্যক্ষণের সৃষ্টি মূলত সংবেদন থেকেই। সংবেদনকে যখন যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তখনই হয় প্রত্যক্ষণ। তাই এ দু'টি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বেশি থাকলেও সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!