মনোযোগের সংজ্ঞা দাও। মনোযোগের ব্যক্তিনিষ্ঠ শর্তাবলি আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য উদ্দীপক আমাদের ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে। আমরা সকল উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করি না। সেসব উদ্দীপকের প্রতি আমরা মনোযোগ দেই, যেগুলো আমাদের প্রেষণায় পরিতৃপ্তি ঘটায় এবং যা আমাদের প্রত্যাশার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমরা অসংখ্য বিষয়বস্তু থেকে নির্বাচন করে দু'একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেই। আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষণ করি তার সব বিষয়ের উপর একই সময়ে মন নিবিষ্ট করা কখনো সম্ভব নয়। কাজেই সাধারণত একটি বিষয়ের পরে আরেকটি বিষয়ে আমরা মনঃসংযোগ করি ।


মনোযোগের সংজ্ঞা দাও। মনোযোগের ব্যক্তিনিষ্ঠ শর্তাবলি আলোচনা কর

মনোযোগ (Attention) :

মনোযোগ বলতে আমরা সাধারণত অসংখ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে একটি বিষয়কে নির্বাচন করে নিয়ে তার উপর মনকে নিবিষ্ট করা এবং অন্যান্য বিষয় থেকে মনকে সাময়িকভাবে দূরে সরিয়ে নেয়াকে বুঝে থাকি। অর্থাৎ মনোযোগ হলো সে মানসিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা চেতনার ক্ষেত্রটিকে সংকুচিত করে মাত্র একটি বিষয়বস্তুতে মনকে নিবিষ্ট করাকে বুঝায় ।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা : মনোযোগ হলো প্রত্যক্ষণের পূর্ববর্তী ঘটনা। প্রত্যক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, ‘মনোযোগ হলো একটি প্রাক প্রত্যক্ষণীয় মনোভাব' । বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে মনোযোগের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।


নিম্নে মনোযোগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :


পিয়ারসন (Pierson) বলেছেন, “মনোযোগ হলো একটি প্রত্যাশা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়া।”


প্যাসক্যাল (Paschal) বলেছেন, “মনোযোগ হলো একটি পূর্ব অনুমতি প্রত্যক্ষণমূলক সমন্বয়।”


ক্রাইডার এবং তার সহযোগীরা (Crider and Others) বলেছেন, “মনোযোগ হলো সে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া যা কোন তথ্য সংবেদী স্মৃতি থেকে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিতে যাবে তা পরিচালনা করে।" (Psychology; Scott, Foresman and Company; 1983; Page-229)


রডিঞ্জার এবং অন্যান্যদের (Roediger and Others) মতে, “মনোযোগকে প্রত্যক্ষণের কেন্দ্রীভূতকরণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যা একটি সীমিত সংখ্যক উদ্দীপককে ব্যাপকতর সচেতনতার দিকে পরিচালিত করে।” (Psychology; Little, Brown and Company, 1984; p. 158)


ফ্রাঙ্ক বি. ম্যাকমোহন (F. B McMohan) এবং জে. ডব্লিউ. ম্যাকমোহন (J. W. McMohan) বলেছেন, "Attention means g on the material presented." (Psychology; The Hybrid Science; The Dorsey Press, 1986 ; P. 241) focusing মেসার (Masser) এর মতে, "Attention is a higher grade of consciousness of an object",


আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক উন্ড (Woundt) এর মতে, “মনোযোগ হলো কোন বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট চেতনা।” গিলফোর্ড (Guilford) বলেছেন, “মানুষ যা প্রত্যক্ষ করে চলেছে, তাকে নির্বাচন করার প্রক্রিয়াকেই মনোযোগ নামে অভিহিত করা হয়।”


মর্গান এবং কিং (Morgan and King ) মতে, "Attention is the term given to the perceptual processes the select certain inputs for inclusion in our conscious experience, or awareness, at any given time."


মনোযোগের ব্যক্তিনিষ্ঠ শর্তাবলি (Subjective conditions of attention) :

মনোযোগ কতকগুলো অভ্যন্তরীণ বা ব্যক্তিগত শর্তের উপর নির্ভরশীল। মনোযোগের ব্যক্তিনিষ্ঠ শর্ত বলতে আমরা সেসব শর্তকে বুঝে থাকি, যেসব অবস্থা ব্যক্তির দিক থেকে মনোযোগ আকর্ষণে সহায়তা করে।


নিম্নে মনোযোগের ব্যক্তিনিষ্ঠ শর্তসমূহ আলোচনা করা হলো :


১. আবেগ : মনোযোগ নির্ধারণ করার ব্যাপারে আবেগ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন- যাকে আমরা ভালোবাসি তার সদগুণের প্রতি আমাদের মনোযোগ ধাবিত হয় (নাইট এবং নাইট), আর যাকে আমরা অপছন্দ করি তার দোষত্রুটিগুলোই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে ।


২. অভিজ্ঞতা : পূর্ব অভিজ্ঞতাও মনোযোগ আকর্ষণ করার এক অন্যতম শর্ত। যেমন- পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিকারি জানে বনের কোথায় শিকারের দেখা পাবে এবং সেখানে পৌঁছে তার মনোযোগ প্রত্যাশিত শিকারের দিকে ধাবিত হয়।


৩. কামনা : কামনা, বাসনা, অভিপ্রায়, মনোযোগ নির্ধারণ করে থাকে। যে ব্যক্তি অর্থের কামনায় উন্মত্ত, তার মনোযোগ সকল সময়েই ধাবিত হয় অধিক অর্থ উপার্জন করার দিকে।


৪. অর্জিত রুচি ও আগ্রহ : যার যে বিষয়ে আগ্রহ তার মনোযোগ সে বিষয়ে বেশি। এজন্য দৈনিক সংবাদপত্রে ক্রীড়ামোদী ব্যক্তি আগে খেলার খবরটি দেখেন এবং ব্যবসায়ী দেখেন বাজার দর। নিজের নাম দেখলে বা শুনলে সাথে সাথেই তার প্রতি আমাদের মনোযোগ ধাবিত হয় ।


৫. অভ্যাস ও শিক্ষা : অভ্যাস ও শিক্ষা মনোযোগ নির্ধারণ করে থাকে। যেমন- ঘুম থেকে উঠেই যার খবরের কাগজ পড়া অভ্যাস, সকালে তার মনোযোগ খবরের কাগজের দিকেই সহজে চলে যায়। বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞান সম্পর্কীয় বিষয়ে, উদ্ভিদতত্ত্ববিদ গাছপালা, ফুল ইত্যাদিতে, প্রাণিতত্ত্ববিদ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীতে মনোযোগী হয়ে থাকেন।


৬. মেজাজ ও মনোভাব : ব্যক্তির মেজাজ ও মনোভাব ও মনোযোগ নির্ধারণের অন্যতম শর্ত। যে ব্যক্তির মেজাজ কোন কারণে তিক্ত, তিনি বাড়িতে সামান্য হৈ চৈ হলে বা বাড়ির কার্পেটে একটু কাদা লাগলে, তার প্রতি মনোযোগী হতে পারেন। যদিও সাধারণ অবস্থায় তিনি এ জাতীয় ঘটনার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন না ।


৭. প্রস্তুতি ও প্রত্যাশা : প্রস্তুতি ও প্রত্যাশার দ্বারা মনোযোগ নির্ধারিত হয়ে থাকে। আমরা যা কিছু দেখতে বা শুনতে প্রস্তুত বা আমরা যা প্রত্যাশা করি সে বিষয়ে আমরা বেশি মনোযোগী হই। উদাহরণস্বরূপ, নিদ্রিত অবস্থায় রোগীর টেলিফোন এলে ডাক্তার সহজেই জেগে উঠেন । কিন্তু অনেক সময় ডাক্তার পত্নীর তাতে নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না। আবার ছোট্ট শিশু কেঁদে উঠলে ডাক্তার পত্নী সহজেই জেগে উঠেন। কিন্তু অনেক সময় তাতে ডাক্তারের ঘুমের ব্যাঘাত হয় না।


৮. ক্লান্তি ও অবসাদ : ব্যক্তির মধ্যে ক্লান্তি বা অবসাদ থাকলে কোন বস্তু বা ঘটনাই তার কাছে আকর্ষিত হবে না। সুতরাং ক্লান্তি ও অবসাদ মনোযোগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মনোবিজ্ঞানী বার্টলেট (Bartlett) (1943) বৈজ্ঞানিকদের উপরে গবেষণা করে দেখেন যে, ক্লান্তি ও অবসাদের ফলে বৈমানিকদের মনোযোগ বিনষ্ট হয়েছে।


৯. মানসিক প্রবণতা : জন্মগত মানসিক প্রবণতাও মনোযোগ নির্ধারণ করে। দক্ষ গায়ক, শিল্পী, চিত্রকর প্রভৃতি জন্মগত মানসিক প্রবণতার জন্যই নিজের বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হন।


১০. মানসিক সুস্থতা : ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা তার মনোযোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রোগ, শোক, দুঃখ, বেদনা প্রভৃতি কারণবশত যদি মন চঞ্চল ও অস্থির হয় এবং মনের স্বাভাবিক সুস্থতা ব্যাহত হয় তাহলে কোন বিষয়ে মনোযোগী হওয়া সম্ভব হয় না।


১১. সহজাত প্রবৃত্তি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মাতৃত্ব, যৌনাবেগ প্রভৃতি আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির নিকট যে বস্তুর আবেদন আছে, সে বস্তুর প্রতি আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। যেমন- শিশুর ক্ষীণ ক্রন্দনও মাতার মনোযোগ আকর্ষণ করে।


১২. স্বাস্থ্য : মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থা তার মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অসুস্থ ব্যক্তি খুব স্বাভাবিক কারণেই ওষুধ বা ওষুধের বিজ্ঞাপনের প্রতি সহজেই মনোযোগী হয়ে পড়ে। তাছাড়া রোগশোকের কারণে মনের স্বাভাবিক সুস্থতা ব্যাহত হলে কোন বিষয়ে মনোমালিন্য

করা সম্ভব হয় না।


১৫. মূল্যবোধ : সমাজকর্মী সামাজিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত, ধর্মবেত্তাগণ ধর্মসংক্রান্ত কথা শুনলে সেদিকে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ যার যেরকম মূল্যবোধ সে তৎসংক্রান্ত বস্তু বা ঘটনার প্রতি অতি সহজেই মনোযোগী হয়ে পড়ে। তাই মূল্যবোধও মনোযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।


উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, মনোযোগ প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের সঠিক মনোযোগের উপরই তার কাজের অগ্রগতি নির্ভর করে। প্রত্যক্ষণ ক্ষেত্রে মনোযোগিতাই হলো মূল বিষয়। মানুষের জীবনে প্রতিটি বিষয়ে সফলতা নির্ভর করে গভীর মনোযোগিতার উপর । কারণ একাগ্রতা বা মনোযোগিতাই হলো সাফল্যের চাবিকাঠি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!