সংবেদন বলতে কি বুঝ? সংবেদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

আমাদের সকল আচরণ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও কার্যকলাপের মূলে রয়েছে সংবেদন। আর সংবেদনের মূল উৎস হচ্ছে। য়ুতন্ত্র। ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন বস্তু সম্বন্ধে মস্তিষ্কে সংযোগ স্থাপিত হয়। এ সংযোগ স্থাপিত না হ বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে কোনরকম ধারণা আমাদের থাকত না। বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন জ্ঞান আহরণ করি বলে ইন্দ্রিয়গুলোকে জ্ঞানের দরজা বলা হয়। যদিও ইন্দ্রিয় বলতে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এ পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে আমরা বুঝে থাকি, কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা ইন্দ্রিয়ের মোট সংখ্যা ১০টি অথবা ১১টি বলে মনে করেন।


সংবেদন বলতে কি বুঝ? সংবেদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।


সংবেদনের সংজ্ঞা :

সংবেদন হল উদ্দীপনার সরলতম ও প্রাথমিক চেতনা বা বোধ। বহির্জগতের কোন উদ্দীপক দ্বারা কোন ইন্দ্রিয় উদ্দীপিত ও উত্তেজিত হলে এ উদ্দীপনা ও উত্তেজনায়ুর মাধ্যমে (Sensory nerve) মস্তিষ্কের বিশেষ স্থানকে উত্তেজিত করে। উত্তেজনার দরুন যে প্রাথমিক চেতনা বা বোধের সৃষ্টি হয়, সে প্রাথমিক চেতনা বা বোধই হল সংবেদন।


ক্রাইডার এবং তাঁর সহযোগীরা বলেছেন, “সংবেদন হল এমন একটি প্রাক্রিয়া যার সাহায্য ইন্দ্রিয়যন্ত্র, যেমন- চক্ষু ও কর্ণ পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে।”


জন সি. রাচ (John C. Ruch) বলেছেন, “সংবেদন বলতে সংবেদীয় প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট মৌলিক অভিজ্ঞতাসমূহকে বুঝায়। যেমন- দর্শন।”


হেনরী এল. রডিজার এবং তাঁর সহযোগীরা বলেছেন, “সংবেদন বলতে পরিবেশ থেকে উদ্দীপনার গ্রহণকে বুঝায়।” ম্যাকমহোন এবং ম্যাকমহোন বলেছেন, “সংবেদন শব্দটি দ্বারা সে প্রক্রিয়াকে বুঝায় যেখানে পৃথিবী থেকে শক্তির (আলো, শব্দ, তাপ ইত্যাদি) আকারে তথ্য গ্রহণ করা হয় এবং এক উপযুক্ত ইন্দ্রিয়ে (দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ) প্রেরণ করা হয়।” মনোবিজ্ঞানী Sully বলেছেন, “একটি অন্তর্মুখীায়ুর বহিঃপ্রান্ত উদ্দীপ্ত হলে যখন সে উদ্দীপনা মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হয় তখন তার দ্বারা সৃষ্ট সহজ মানসিক প্রক্রিয়াই হল সংবেদন । ”

মনোবিজ্ঞানী Sandford এর মতে, “কোন ইন্দ্রিয় স্থান থেকে নায়বিক শক্তি মস্তিষ্কের কোন কেন্দ্রে বাহিত হলে যে সহজ চেতনার উৎপত্তি হয় তাকে সংবেদন বলে।”


সুতরাং, উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, বহির্জগতের উদ্দীপক ইন্দ্রিয়ে আঘাত করলে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, তা মস্তিষ্কে বাহিত হলে যে সহজ চেতনার উদ্ভব হয়, তাকে সংবেদন বলে।


সংবেদনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of sensation) :

সংবেদনের এমন কতকগুলো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে যার মাধ্যমে সহজেই একে অন্যান্য মানসিক প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। নিত সংবেদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হল : ১. উদ্দীপক সংবেদন সৃষ্টির জন্য দায়ী : উদ্দীপক ছাড়া সংবেদন সম্ভব না। উদ্দীপক এক প্রকার শক্তি। উদ্দীপক কোন ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করলে সে উদ্দীপনা অন্তর্মুখীায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হলে সংবেদনের সৃষ্টি হয়। যেমন- আলোক রশ্মি চক্ষুকে উদ্দীপিত করে এটা দৃষ্টিগত এবং সংবদনের উদাহরণ ।


২. সংবেদনের গুণগত পার্থক্য রয়েছে :

একেকটি ইন্দ্রিয়ের উত্তেজনা এক একটি বিশেষ ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করে। এর কারণ হল প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের বিশেষ ধরনের গড়ন এবং বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি কার্যকারিতা। শ্রবণেন্দ্রিয় বিশেষ ধরনের কোষের জন্য এটি শব্দ উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দিতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে চোখের বিশেষ ধরনের কোষের গড়নের জন্য এগুলো আলোর প্রতি সাড়া দিতে পারে, এমনিভাবে বিভিন্ন উদ্দীপক বিভিন্ন ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করে।


৩. সংবেদনের তীব্রতার পার্থক্য রয়েছে :

উদ্দীপকের তীব্রতার উপর সংবেদনের তীব্রতা নির্ভর করে। উদ্দীপকের তীব্রতা কমলে সংবেদনের তীব্রতা কমে। আবার উদ্দীপকের তীব্রতা বাড়লে সংবেদনের তীব্রতা বাড়ে। যেমন- একটা মোমবাতির আলোর চেয়ে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতির আলোর তীব্রতা বেশি। ২৫ ওয়াট বাল্বের আলোর চেয়ে ১০০ ওয়াট বাল্বের আলোর তীব্রতা বেশি।


৪. সংবেদনের স্থায়িত্ব রয়েছে :

উদ্দীপকের স্থায়িত্বের উপর সংবেদনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। কোন উদ্দীপক কতক্ষণ স্থায়ী হবে তা নির্ভর করে উদ্দীপক যতক্ষণ পর্যন্ত ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত রাখবে তার উপর। একটি মিউজিক কয়েক সেকেন্ড বাজানো হল এবং অন্য একটি মিউজিক কয়েক মিনিট বাজানো হল এখানে প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টির শব্দ সংবেদনের স্থিতিকাল বেশি।


৫. সংবেদনের ব্যাপকতা :

কোন উদ্দীপক যতটুকু জায়গা জুড়ে অনুভূত হয় বা যতটুকু জায়গা দখল করে সংবেদনও পরিমাণ জায়গা ব্যাপী স্থায়ী থাকে। যেমন- আমি প্রথমে একটা একতলা বাড়ির দিকে তাকালাম পরে পাঁচতলা বাড়ির তাকালাম। এটা দৃষ্টিগত সংবেদন। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টির ব্যাপ্তি অনেক বেশি।


৬. সংবেদনের স্পষ্টতা :

সব সংবেদন একরকমের নয়। কোন সংবেদন বেশি স্পষ্ট আবার কোন সংবেদন কম স্পষ্ট। যে সংবেদন চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেটি স্পষ্ট এবং যেটি প্রান্তে থাকে সেটি কম স্পষ্ট।


৭. সংবেদন সংকেত হিসেবে কাজ করে :

সংবেদন পরিবেশের উদ্দীপকসমূহের প্রতি উপযোগী প্রতিক্রিয়া করার জন্য সংকেত গেছে, কুকুরকে খাদ্য দেওয়ার পূর্বে একটি সুর বাজানো হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কুকুরটির মুখ থেকে লালা ক্ষরণ হতে থাকে। হিসেবে কাজ করে। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, প্যাভলভ এর চিয়ারত সাপেক্ষণ এর কথা উল্লেখ করা যায়। সাপেক্ষণ পরীক্ষণে দেখা এবং সুরটি খাদ্যের সংকেত হিসেবে কাজ করে।


৮. সংবেদন সমতা :

রাত্রিবেলা হঠাৎ করে বিদ্যুত চলে গেলে প্রথমে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সবই দেখা যায়। আবার অন্ধকার কক্ষে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলে প্রথমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে এবং কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু অল্প সময়েই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী এ অভিযোজনই হল সংবেদন সমতা।


৯. সংবেদন স্থানীয় প্রক্রিয়া :

সংবেদনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটা একটি স্থানীয় প্রক্রিয়া। শরীরের কোন স্থানে স্পর্শ করলে না দেখেই তা সঠিকভাবে বলে দেওয়া যায় । অথবা, একই সাথে দু'টি শব্দ শুনে আমরা তা পার্থক্য করতে পারি। সংবেদনের স্থানীয় প্রক্রিয়ার জন্যই তা সম্ভব ।


১০. প্রান্তীয় ঘটনা :

কোন বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক চেতনা বা বোধ হল সংবেদন। আর সংবেদনের অর্থ বা ব্যাখ্যা হল প্রত্যক্ষণ। এ জন্য সংবেদনকে প্রান্তীয় ঘটনা এবং প্রত্যক্ষণকে কেন্দ্রীয় ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়।


১১. সংবেদনের পার্থক্য সীমা :

দু'টি উদ্দীপকের মধ্যে ন্যূনতম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পার্থক্যই হল পার্থক্য সীমা। পার্থক্য সীমা সংবেদনের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।


১২. নিসীমা :

প্রতিটি পার্থিব শক্তি (উদ্দীপক) আমাদের চেতনায় আঘাত করার জন্য একটি নিতম মাত্রার প্রয়োজন। উদ্দীপকের যে নিশক্তি ব্যক্তির মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে নিসীমা বলে ।


১৩. উচ্চসীমা :

সংবেদনের একটি সর্বোচ্চ সীমা আছে যা অতিক্রম করলে কোন সংবেদন হয় না একেই সংবেদনের উচ্চসীমা বলে। যেমন— একটি টেলিভিশন বন্ধ অবস্থা থেকে চালু করতে গেলে এবং তার শব্দ শোনার জন্য যদি শব্দের বোতামকে ঘুরিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়, তবে দেখা যাবে এত শব্দ হচ্ছে যে সেখানে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না ।


১৪. সংবেদন বস্তুকেন্দ্রিক মানসিক অবস্থা :

সংবেদন বস্তুকেন্দ্রিক মানসিক অবস্থা। অনুভূতি মানসিক অবস্থা হলেও অনুভূতি আকেন্দ্রিক নয়, সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমার আনন্দ, আমার দুঃখ, আমার মনের অবস্থা কোন বস্তুর গুণ নয়। কিন্তু সংবেদন মানসিক অবস্থা হলেও বস্তুকেন্দ্রিক। যেমন- কোন রঙের সংবেদন। এ রঙ কোন বস্তুর গুণ, আমার মনের কোন অবস্থা নয় ।


১৫. সংবেদন নিষ্ক্রিয় অবস্থা :

সংবেদন মূলত নিষ্ক্রিয় অবস্থা অর্থাৎ, সংবেদনের ক্ষেত্রে মন নিষ্ক্রিয়ভাবে বাইরের জগত থেকে উদ্দীপনাগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি কি ধরনের সংবেদন লাভ করবে, তা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না ।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, সংবেদন হচ্ছে পরিবেশ বা বহির্জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটি প্রধান ও প্রথম শর্ত । সংবেদন প্রক্রিয়া মূলত উদ্দীপক গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যাখ্যার জন্য বিশেষায়িত।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!