জরিপ কি? জরিপ পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

সকল বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত অনুধ্যানের জন্য কতকগুলো পদ্ধতি থাকে। কোন পর্যালোচনার ক্ষেত্র ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে উক্ত পর্যালোচনা কতটুকু সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য। সমাজ মনোবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান। অন্যান্য বিজ্ঞানের মত সমাজ মনোবিজ্ঞানেরও নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। পদ্ধতি হচ্ছে বিজ্ঞানের কোনকিছু বিশ্লেষণের মান নির্ণায়ক। পদ্ধতি হচ্ছে সুনিশ্চিত এবং যা মূল্যহীন নয় । প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, আর এ পদ্ধতি আছে বলেই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলো এত সুসংহত হয়।


জরিপ কি? জরিপ পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা ব্যাখ্যা কর।


জরিপ পদ্ধতি :

অনেক সময় কোন বিশেষ গবেষণার ক্ষেত্রে জনগণের সাথে সরাসরি সংযোগের প্রয়োজন হয়। জনগণের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের বৈশিষ্ট্য আচরণ, মনোভাব ইত্যাদির লেখ্য (recerd) নেওয়া হয়। এ ধরনের পর্যালোচনাকে Survey বা জরিপ বলা হয়। জরিপ পদ্ধতি সমাজ মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি। সামাজিক আচার আচরণ উপলব্ধি করার জন্য সামাজিক সমস্যাবলির সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য সমাজ মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে জনপ্রিয় ও ব্যাপক প্রচলিত তথ্যানুসন্ধান পদ্ধতি হল জরিপ পদ্ধতি। সামাজিক জরিপ হল এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে সামাজিক অবস্থা, সম্পর্ক, আচরণ, সংলাপ, সম্পদ, চাহিদা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা গঠনমূলক সামাজিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথ সুগম করে নেয় ।


এ পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এ যে, অনেক বড় জনসংখ্যার উপর অল্প সময়ে প্রশ্নমালা প্রয়োগের মাধ্যমে তথ্য সংগৃহীত হয়। এ ধরনের গবেষণায় সাধারণত জনসংখ্যাকে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভাগ করে নমুনা নির্ধারণ করা হয় এবং সে নমুনার উপর প্রশ্নমালা প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কালে এ ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনেক সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। তবে সফলভাবে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, যে প্রশ্নমালার সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে সেটি গবেষণার উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে যথাযথ হয়েছে কি না।


প্রশ্নামালা প্রণয়নের ব্যাপারে গবেষককে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যে বিষয়টি সকল দিকে অন্তর্ভুক্ত হল কি না। এরপর লক্ষ্য রাখতে হবে প্রশ্নামালা যাতে প্রয়োজনানুগ, সহজ বোধ্য ও সুস্পষ্ট হয় এবং একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি না হয়। প্রশ্নমালা দু'ভাবে প্রণয়ন করা যেতে পারে। যথা : মুক্তপ্রান্ত (open ended) ও রুদ্ধপ্রান্ত (close ended) বা কাঠামোবদ্ধ (structured)। মুক্তপ্রান্ত প্রশ্নে উত্তরদাতা যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর দিতে পারেন।


উদাহরনস্বরূপ, শিশুকে প্রহার করার ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন? এক্ষেত্রে উত্তরদাতা যে কোনভাবে তার উত্তর দিতে পারেন। কিন্তু কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে তা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ঐ প্রশ্নটির কয়েকটি সম্ভাব্য প্রশ্নপত্রে উল্লেখ করা থাকে এবং উত্তরদাতার কাজ হবে ঐসব উত্তরের মধ্যে থেকে তার নিজস্ব উত্তরটি চিহ্নিত করা। গবেষক তার গবেষণার উদ্দেশ্য ও সুবিধা অনুযায়ী প্রশ্নমালায় মুক্তপ্রান্ত বা কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন প্রণয়ন করে থাকে ।


প্রশ্নমালা প্রণয়নে সতর্কতার সাথে সাথে নমুনা চয়নের দিকেও যত্ন নেওয়া আবশ্যক। গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সংগতি রেখে নমুনা যাতে জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বমূলক হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন ।


জরিপ পদ্ধতির সুবিধা :

বর্তমানকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক জরিপ পদ্ধতির বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, এর মূলে রয়েছে জরিপ পদ্ধতির কতিপয় সুনির্দিষ্ট সুবিধা। সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিৎসাগত, বাজার ও বিপণন, জনমত, রাজনৈতিক, গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে জরিপের সফল ভূমিকা পদ্ধতির উপযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। সামাজিক জরিপের সুবিধাগুলো হল :


১. সামাজিক জরিপ বিশ্লেষণাধীন বিষয়ের সামগ্রিক অথবা এর একটি প্রতিনিধিত্বশীল অংশ অনুসন্ধান সক্ষম জাতীয় পর্যায়ের নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রশাসনে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে থাকে ।

এর মাধ্যমে জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

৪. সামাজিক জরিপ অতি ক্ষুদ্র এলাকা বা বিশাল এলাকায় করা যায় ।

৫. যে কোন সমস্যা সম্পর্কে গভীর ও সার্বিকভাবে জানতে, নির্ণয়ে ও তার বিকল্প সমাধান নির্বাচনে সহায়তা করে।

৬. সামাজিক পরিবর্তনের ধারা ও বিশৃঙ্খলার মাত্রা এবং কারণসমূহ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে ।

৭. বিপুল সংখ্যক সামাজিক উপাদানের উপর অনুসন্ধান কাজ চালানো যায়।

৮. একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যম হল জরিপ।

৯. সামাজিক জরিপ গবেষণায় নমনীয়তা নীতি বিদ্যমান থাকে।

১০. একটি বৃহৎ দেশের কোন সামাজিক বিষয়ে কেবল জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ।

১১. তুলনামূলক অনুসন্ধানে সহায়তা করে এবং বহুবিধ সামাজিক চলকের প্রকৃত সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারে। ১২. ব্যাপক বিষয়ে একক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা যায় ।

১৩. পরীক্ষণমূলক নকশার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ।

১৪. নমুনাজাত ভ্রান্তি পরিমাপ ও অনুমানজাত ভ্রান্তি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা যায় বলে প্রাপ্ত তথ্যাবলি অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য হয়।

জরিপ পদ্ধতির অসুবিধা : প্রচলিত, জনপ্রিয় এবং উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক জরিপ পদ্ধতির যেসব অসুবিধা পরিলক্ষিত সেগুলো নিম্নরূপ। যেমন-

১. সামাজিক জরিপ বেশ ব্যয়বহুল এবং এতে অনেক লোকবল ও সময়ের প্রয়োজন হয়।

২. সামাজিক জরিপের মাধ্যমে সামাজিক উপাদান সম্পর্কিত সুগভীর কোন তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না।

৩. সুবিস্তৃত জরিপ কাজে অপ্রত্যাশিত জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে ।

৪. জরিপলব্ধ তথ্যাবলিতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধের বিজড়নের সম্ভাবনা থাকে ।

৫. সঠিক ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে ভ্রান্ত ও অনির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬. জরিপলব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে তেমন কোন সাধারণীকরণ অথবা ভবিষ্যদ্বানী প্রদান করা যায় না ।

৭. সামাজিক জরিপ যেহেতু গবেষক এককভাবে পরিচালনা করতে পারে না। তাই অন্যান্য তথ্য সংগ্রহকারীর উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এতে করে কর্মীদের কাছ থেকে ভ্রান্ত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জনমত যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় । সমাজ মনোবিজ্ঞানে জরিপের মাধ্যমে প্রধানত ব্যক্তির মতামত ও আচরণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক জরিপ বর্তমানে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও প্রচলিত তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত ।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!