বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা কর ।

admin

ভূমিকা :

যেসব উপাদান ও ভৌত সুবিধাদি কোন দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার নিমিত্তে ভিত্তি বা বুনিয় হিসেবে কাজ করে তাকে অবকাঠামো বলে। একটি দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য কতিপয় মৌলিক সুযোগ সুবিধার উপস্থিতি অপরিহার্য। যেমন- বাঁধ, সেতু, রাস্তা, শিক্ষা, কারিগরি সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি ।


বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা কর


বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ভূমিকা :

পরিবহণ ও যোগাযেগ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবহণ ও যোগােযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ভূমিকা আলোচনা করা হল :


১.কৃষি উন্নয়ন :

বাংলাদেশে কৃষির উন্নয়ন করতে হলে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি অপরিহার্য। আমার কৃষিক্ষেত্রে ভালো বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ, উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ইত্যাদির প্রয়োগ করতে পারলে কৃষিতে ফলন বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত হলে এসব কৃষি উপকরণ স্বল্প সময়ে এবং অল্প খরচে আমাদের গ্রামাঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে সরবরাহ করা সহজতর হবে। ফলে আমাদের কৃষি উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।


২. শিল্পের উন্নতি :

কোন দেশের শিল্পায়ন প্রধানত উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। পরিবহণ। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি ভাতি সহজেই শিল্পাঞ্চলে প্রেরণ করা যায় এবং শিল্পজাত পণ্যগুলো দেশবিদেশের বিভিন্ন উন্নত বাজারে কম খরচে পাঠানো সম্ভব হয়। উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে একদিকে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে শিল্পজাত পণ্যের বাজারও বিস্তত হয়।


৩. বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন :

দেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার বিস্তৃত হয়। যাতায়াত ও পরিবহণ ব্যবস্থা অনুন্নত বলে আমাদের দেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য দূরবর্তী উৎকৃষ্ট বাজারে প্রেরণ করে পারে না। ফলে তারা ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় না। যাতায়াত ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষকরা তাদের ফসলগুলো এবং শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দূরবর্তী বাজারসমূহে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় করতে সক্ষম হবে।


৪. জরুরি অবস্থার মোকাবিলা :

পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশে যে কোন জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। দেশের কোন অঞ্চলে বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দেখা দিলে সে অঞ্চলে অতি দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর প্রয়োজন হয়। উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা উপদ্রুত অঞ্চলের জনগণকে দুর্যোগ হতে দ্রুত উদ্ধার করে।


৫. শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি :

কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শ্রমের গতিশীলতা একান্ত প্রয়োজন। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের এক অঞ্চলের শ্রমিকগণ অন্যান্য অঞ্চলে স্বল্প সময়ে এবং কম খরচে যাতায়াত করতে পারবে। এর ফলে শ্রমিকদের বেকারত্ব দূর হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের মজুরি হারের তারতম্যও দূরীভূত হবে ।


৬. ঘাটতি পূরণ :

দেশের কোন অঞ্চলে খাদ্যশস্য বা অন্য যে কোন দ্রব্যের ঘাটতি দেখা দিলে উন্নত পরিবহণ ও যাতায়া ব্যবস্থার সাহায্যে উক্ত ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়। যাতায়াত ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত হলে কোন অঞ্চলের উৎপাদিত উ পণ্যসামগ্রী সহজেই ঘাটতি এলাকায় প্রেরণ করা যায়। এভাবে পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন এলাকায় দ্রব্যসামগ্রীর ঘাটতি পূর

করা হয়।


৭. দ্রব্যমূল্যের সমতা :

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একই পণ্য বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। কারণ কোন অঞ্চলে কোন নির্দিষ্ট পণ্যের ঘাটতি থাকলে তার দাম বেশি এবং ঐ একই পণ্য অন্য কোন অঞ্চলে উদ্বৃত্ত থাকে বলে তার দাম কম হয়। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে পণ্যসামগ্রী স্থানান্তর করা সহজতর হবে। ফলশ্রুতিতে দেশের সর্বত্র দ্রব্যমূল্যের সমতা বিরাজ করবে।


৮. কর্মসংস্থান সৃষ্টি :

পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে আমাদের দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ও আয়ত্তর বৃদ্ধি পাবে। রেল, সড়ক, নৌ, বিমান ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবহণে এবং বেতার, টেলিভিশন, টেলিফোন, ডাক ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থায় বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে তা দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও সহায়তা করে।


৯. ভারসাম্যবিশিষ্ট উন্নয়ন :

পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত বলে আমাদের দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করে। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে কলকারখানা ও বাণিজ্য কেন্দ্রসমূহ গড়ে উঠবে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস পাবে এবং দেশে সুষম ও ভারসাম্যবিশিষ্ট উন্নয়ন সম্ভব হবে।


১০. কুটিরশিল্পের উন্নয়ন :

কুটিরশিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে যেসব ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পজাত পণ্যসমূহ উৎপাদিত হয় উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের শহরাঞ্চলে আনয়ন করা সহজ হয়। এর ফলে উৎপাদিত পণ্যসমূহ ন্যায্য দাম পায় এবং কুটিরশিল্পের বাজার বিস্তৃত হয়।


১১. সম্পদের সুষম বন্টন :

দেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সর্বত্র সমানভাবে উন্নত হলে দেশের সর্বত্র সম্পদ ও উৎপন্ন দ্রব্যের সুষম বন্টন হতে পারে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। এভাবে সম্পদ ও আয়ের সুষম বন্টন সম্ভব হয়।


১২. রপ্তানি বৃদ্ধি :

পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সহজেই নদী ও সমুদ্র বন্দরে আনা সম্ভব হয়। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ।


১৩. প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে :

বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনকে সারাদেশে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে থানাসমূহের সাথে জেলা ও বিভাগের সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে প্রশাসন কার্য সহজ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাহ করা সম্ভব হবে।


১৪. প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি :

উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে সরকারি কর্মচারীগণ একস্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত চলাচল করতে পারে এবং জনগণের অভাব অভিযোগ নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে ।


১৫. গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস :

উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করে। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পায় এবং গ্রামের লোকেরা সহজেই শহরাঞ্চলে বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ পায় । এর ফলে গ্রাম ও শহর অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য হ্রাস পায়।


১৬. সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ :

উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পায়। ফলে গ্রামের লোকজন শহরে আসার সুযোগ পায়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটে এবং গ্রামীণ সমাজ হতে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, বিভিন্ন গোঁড়ামি দূরীভূত হয়। সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।


১৭. অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে :

উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তরে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। দেশের অভ্যন্তরে কোন এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে দ্রুত সে এলাকায় পুলিশ ও আনসার বাহিনী প্রেরণের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে দ্রুত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন সর্বাধিক।


১৮. বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ :

বিদেশী শত্রুর আক্রমণ হতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রেও উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা সহজ হয়। বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ হতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য দ্রুত অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ও সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হলে উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন ।


১৯. সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন :

পরিশেষে বলা যায় একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি বহুলাংশে দেশের উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণে সহায়ক বলে অর্থনৈতিক উন্নতি দ্রুততর করা সম্ভব হয়ে ওঠে। উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করা সম্ভব নয় ।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। সুতরাং বলা যায় যে, বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!