সামাজিক ইতিহাস কি? সামাজিক ইতিহাসের পরিধি আলোচনা কর।

admin

ভূমিকাঃ

সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে সামাজিক ইতিহাস। অন্য সকল বিজ্ঞানের যেমন অতীত ইতিহাস রয়েছে তেমনি সমাজ বিজ্ঞানেরও রয়েছে সামাজিক ইতিহাস। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর মতোই সমাজ চলমান ও গতিশীল। তাই সমাজের অতীত রূপ কি ছিল তা জানার জন্য মানুষের মনে স্বাভাবিক ভাবেই আল্লাহ জন্যে। আর সামাজিক ইতিহাসের মধ্যেমেই অতীতের সামাজিক মানুষের জীবন প্রণালি সম্পর্কে জানা যায়। অর্থাৎ সামাজিক জীবনের ক্রমবর্ধমান ও ক্রমবিবর্তন স্তরসমূহের বিবরণ সামাজিক ইতিহাসের মাঝে পাওয়া যায়। তাই সমাজের আদিরূপকে জানতে হলে সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা আবশ্যক। তবে অতীতের সমাজব্যবস্থার সাথে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কিছুটা যোগসূত্র থাকতে দেখা যায়। তাছাড়া নতুন প্রজন্ম তা রদবদল করতে পারে, আর তা নির্ভর করে মানুষের চিন্ত ধারার উপর।


সামাজিক ইতিহাস কি? সামাজিক ইতিহাসের পরিধি আলোচনা কর


সামাজিক ইতিহাস :

সাধারণত সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে কোনো একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনযাত্রার অতীত বর্ণনা যা সামাজিক অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। অন্যভাবে বললে বলা যায় সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে অতীত সমাজস্থ মানুষ এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের কার্যাবলির বিজ্ঞান ভিত্তিক বর্ণনা ও বিশ্লেষণ ।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা :

বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী বিভিন্ন ভাবে সামাজিক ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :


সমাজবিজ্ঞানী Vico তাঁর The New Science গ্রন্থে বলেন, “সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন ঘটনাঃ যেমন- প্রথা, আচার-আচরণ জীবন প্রণালি, অনুধাবন, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত ইতিহাস।

তাঁর মতে, “শুধু রাষ্ট্র বা রাজা-বাদশাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনীই নয় বরং সামাজিক আইন প্রথা, সমাজস্থ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম, ভাষা, শিল্পকলা, ইত্যাদি সবই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়।”


ড. মাহমুদা ইসলামের মতে, “সামাজিক ইতিহাস হলো মানুষ ও তার সমাজের সম্পর্কের ধারাবাহিক বর্ণনা।” সমাজ বিজ্ঞানী G.M. Trevelyon বলেন, “সামাজিক ইতিহাস হচ্ছে কোনো জাতির বা সমাজের রাজনীতি বর্জিত ইতিহাস।"


সমাজ বিজ্ঞানী Gould and Kolb সম্পাদিত 'A Dictionery of The Social Science' গ্রন্থে বলা হয়েছে, “সামাজিক ইতিহাস হলো সেই ইতিহাস যা পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ও সামাজিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের ধারা নিয়ে আলোচনা করে।


F.R. Khan তাঁর 'Social History' গ্রন্থে বলেছেন, "সামাজিক ইতিহাস হলো মানুষের সাধারণ জীবন প্রণাদি এবং তাদের সামাজিক সমস্যা, প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার উন্নতি পরিচালনাসহ এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে প্রতিবাহিত হওয়ার স্বরূপ বর্ণনা।


উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাস কেবল রাজনীতি বিবর্জিত ইতিহাস নয়। সামাজিক ইতিহাস হলো সামাজিক মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামো এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধের যুক্তি প্রমাণ নির্ভর তথা বিজ্ঞান ভিত্তিক অধ্যয়নের এক সুশৃঙ্খল ধারা।


সামাজিক ইতিহাসের পরিধি :

সমাজকে নিয়ে সামাজিক ইতিহাসের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা হয়ে আসছে। তাই সামাজিক ইতিহাসের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। নিচে সামাজিক ইতিহাসের পরিধি আলোচনা করা হলো-


১. অতীত সমাজের বিবর্তন জানার ক্ষেত্র : অতীত সমাজ কিভাবে গড়ে উঠেছিল, সে সমাজ কেমন ছিল, কিভাবে সমাজের উৎপত্তি হলো, সামাজিক রীতি-নীতি কিভাবে মানুষের মধ্যে প্রয়োগ হলো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সামাজিক ইতিহাস যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করে। অতএব সামাজিক ইতিহাসের পরিধি অনেক বেশি।


২. অতীত সমাজের রীতি-নীতি সম্পর্কে : পৃথিবীর ইতিহাস অতি প্রাচীন। এখানে অনেক জাতি, অনেক সম্প্রদায়, অনেক গোষ্ঠী তাদের পবিত্র জীবন ধারা নিয়ে বসবাস করে গেছে। সময়ের ব্যবধানে তাদের প্রথা, অভ্যাস, ভাষা, খাদ্য, সম্পতি রীতিনীতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। মূলত অতীত সমাজের এসব কিছুর ধারণা আমরা সামাজিক ইতিহাসের মাধ্যমে অবগত হতে পারি। কেননা এসব বিষয়বস্তু নিয়ে সামাজিক ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে।


৩. ভবিষ্যৎ অগ্রগতির দিক নির্দেশনা : প্রকৃতপক্ষে সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং সমাজের মূল্যায়ন নিরূপণ করাই হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। সমাজ সবর্দা পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই মানুষের যেমন পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি আবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্তনের সাথে সমাজের রূপও পরিবর্তিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুনদের কাছে সমাজের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে পুরাতনরা। আর নবাগতরা পুরাতন ও বর্তমানের সামাজিক রীতিনীতি মূল্যবোধ ও ধর্ম বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত করে ভবিষ্যতের সুখী ও সুষ্ঠু জীবন ব্যবস্থা। অতএব সামাজিক ইতিহাসের নবাগতদের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে।


৪. ঐতিহাসিক ধারা বিবর্তনের ক্ষেত্রে : ইতিহাসের ধারাকে অবলম্বন করেই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে আহরণ করতে পারে। কারণ ইতিহাস মানুষকে বাস্তব শিক্ষা দিয়ে থাকে। ইতিহাসের এই চিরন্তন ধারা কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা প্রতিনিয়তই এক গোষ্ঠী থেকে অপর গোষ্ঠির মাঝে সংক্রামিত হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকগণ এ চলমান গতিকে ঐতিহাসিক ধারা বলেছেন। মূলত সামাজিক ইতিহাসের মাধ্যমেই এসব জানা যায়।


৫. জীবন প্রণালি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে : সামাজিক ইতিহাস সকলকেই অবগত করিয়ে দেয় যে, কিভাবে উৎপাদন পদ্ধতি যারা মানুষ ক্রমান্বয়ে ঐতিহাসিক ধারা অতিক্রম করে চলে আসছে। এটি সমগ্র মানব জাতির জীবন ধারা, আদর্শ, উদ্দেশ্য, উত্থান, পতন, সংহতি ও ঐক্যহীনতার বিস্তারিত আলোচনা করে থাকে যা আমাদের জীবন প্রণালি নিবীত করার এক বিশেষ উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।


৬. মানুষের জীবন ধারার ক্ষেত্রে : সামাজিক ইতিহাস মানুষের জীবন ধারার বর্ণনা প্রদান করে। তার উত্থান- পতনের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নিয়ে থাকে এবং জাতীয় জীবনে একতা ও সংহতি কতটুকু সফলতা বয়ে আনতে পারে তা বর্ণনা করে। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল জাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের কার্য-প্রণালির ক্রমবিবর্তনের ধারা সমূহকে সমাজস্থ মানুষের সামনে তুলে ধরে। সুতরাং সামাজিক ইতিহাস পড়ে পৃথিবীর সকল জাতির প্রাচীন জীবন প্রণালি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়।


৭. সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ক্ষেত্রে : সামাজিক ইতিহাস বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও তুলে ধরে। যদিও সমাজ বিজ্ঞানী Vico বলেছেন, "Social history is the history of a people অবস্থার সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে। with the politics left out." তাই সামাজিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে।


৮. সমাজের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন সম্পর্কে : সমাজের উৎপত্তি ক্রম-বিকাশ এবং এর বিবর্তন সম্পর্কে সামাজিক ইতিহাস একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রমাণ করে থাকে। তাছাড়া সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রয়োজনীয় কাঠামো সামাজিক ইতিহাসের বহুল আলোচিত বিষয়। সুতরাং মানব সমাজের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে সামাজিক ইতিহাস। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে।


৯. সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে : সামাজিক ইতিহাসে, মাধ্যমে আমরা অতীত সামজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। সেকালের মানুষের সুখ, দুঃখ এবং তাদের নানা সমস্যার পরিচয় আমরা সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পাই।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাসের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। এ পরিধি শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট। জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর পরিধি সমগ্র মানব জাতির জীবন প্রণালি নিয়ে। সুতরাং অতীত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে ভবিস্যতের করণীয় কার্যনির্ধারণ করতে হলে সামাজিক ইতিহাস পাঠ করার গুরুত্ব রয়েছে অনেক বেশি। তাছাড়া মানুষ, সমাজ ও সামাজিক ইতিহাস পরস্পর সম্পর্কিত। তাই মানুষের সকল দিকে এর পরিধি বিস্তৃত।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!