উত্তরঃ সাধারণ অর্থে বাজার বলতে কোন স্থানকে বুঝায়। যেখানে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়বিক্রয় করা হয়। যেমন-বাংলাবাজার, সাহেব বাজার, মৌলভীবাজার ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনীতিতে বাজার শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থনীতিতে বাজার বলতে কোন দ্রব্যকে বুঝায়, যা ক্রয়বিক্রয় নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় এবং এরূপ দর কষাকষির মাধ্যমে একটা নির্ধারিত দামে দ্রব্যটি ক্রয়বিক্রয় হয়। এক্ষেত্রে ক্রয়বিক্রয় যে কোন স্থান হতে পারে। বাজারের সংজ্ঞার ভিত্তিতে বাজারের উদাহরণ হচ্ছে-চাউলের বাজার, মাছের বাজার, স্বর্ণের বাজার ইত্যাদি। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বাজারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
অধ্যাপক চ্যাপম্যান এর মতে, “বাজার বলতে কোন স্থানকে বুঝায় না বরং এক বা একাধিক দ্রব্যকে বুঝায়, যা ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্রয়বিক্রয় হয়।”
ফরাসি অর্থনীতিবিদ কুর্নটের মতে, “অর্থনীতিবিদগণ বাজার শব্দ দ্বারা দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়বিক্রয়ের কোন বিশেষ স্থানকে বুঝায় না; বরং যে কোন অঞ্চলের সমগ্রটিকে বুঝায়, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার পরস্পর অবাধ সংযোগের মাধ্যমে দ্রব্যাদির মূল্য সহজে ও দ্রুততার সাথে সমান হবার প্রবণতা দেখা যায়।”
উপরে উল্লিখিত সংজ্ঞা দু'টি বিশ্লেষণ করলে বাজারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। যেমন- (১) একদল ক্রেতা ও বিক্রেতা (২) এক বা একাধিক দ্রব্য (৩) এক বা একাধিক অঞ্চল এবং (৪) ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দামের উদ্ভব।
এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে বলা যায়, কোন প্রব্যের ক্রয়বিক্রয় নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার কলে একটি নির্দিষ্ট নামের উদ্ভব হলে অর্থনীতিতে তাকে বাজার বলে।
পূৰ্ণ প্ৰতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য :
কোন বাজার পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক হবে কিনা তা নির্ধারণের জন্য নিম্নের শর্ত বা বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে-
১. অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল অসংখ্য ক্রেতা ও - বিক্রেতার সক্রিয় অংশগ্রহণ। অর্থাৎ, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যে দ্রব্যের লেনদেন হয় তার অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা থাকে। অসংখ্য উৎপাদনকারী ফার্মের উৎপাদন দ্বারা শিল্পের যোগান নির্ধারিত হয়। সেখানে ফার্ম শিল্পের মোট উৎপাদনের একটি নগণ্য অংশ উৎপাদন করে। তাই সে যোগানের হ্রাসবৃদ্ধি করে কোন ভোক্তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আবার ক্রেতার সংখ্যা অসংখ্য থাকে বলে কোন উৎপাদনকারীর উপর কোন একজন ভোক্তার একক প্রভাব থাকে না। মোট কথা, অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা থাকায় পূর্ণ প্রতিযোগিতায় দ্রব্যের বাজার চাহিদা ও বাজার যোগান এবং মূল্যের উপর কোন বাহ্যিক প্রভাব থাকে না। ফলে প্রত্যেক উৎপাদক/ফার্ম যে মূল্যে পণ্য বিক্রয় করে সে মূল্যে প্রত্যেক ক্রেতা দ্রব্য জয় করে। এখানে কোন শ্রেণির একচেটিয়া প্রভাব শূন্য।
২. সমজাতীয় গ্রন্থ : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্রব্যের সমজাতীয়তা। অর্থাৎ, পণ্যের প্রতিটি একক হুবহু এক (identical)। পরিমাণগত এবং গুণগত দিক থেকে পণ্যের একটি একক থেকে অন্য একক পৃথক করা যায় না। যা দ্রব্যগুলোর আড়াআড়ি স্থিতিস্থাপকতা অসীম হতে সহায়তা করে। একজন উৎপাদনকারীর উৎপাদিত প্রব্যের দাম দ্বারা অন্যজনের উৎপাদনের পরিমাণ মোটেও প্রভাবিত হবে না। এরূপ প্রব্যের ক্ষেত্রে কোন ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট অথবা লেবেলের মধ্যেও পার্থক্য থাকবে না। এমনকি দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যে সেবা রয়েছে তাও সমজাতীয়। অর্থাৎ, বিক্রেতা কোন আকর্ষণীয় আচরণ দ্বারা ভোক্তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতা এবং সমজাতীয় দ্রব্য শর্ত দ্বারা পূর্ণ প্রতিযোগিতায় একটি কার্য কেবল মূল্য গ্রহীতা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যেখানে ফার্মের গড় ও প্রান্তিক আয় বেখা ভূমি অক্ষের সমান্তরাল।
৩. শিল্পে ফার্মের অবাধ প্রবেশ ও নির্গম : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ক্ষেত্রে কোন শিল্পে ফার্ম অবাধে প্রবেশ করতে পারে এবং প্রয়োজনবোধে শিল্প ত্যাগ করতে পারে। স্বল্পকাল স্থির উপাদান থাকে বলে কোন ফার্ম শিল্প ক্ষেত্র পরিত্যাগ করা অথবা নতুন ফার্ম শিল্পে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। তাই এ শর্তটি দীর্ঘমেয়াদে প্রযোজ্য । এ সময় উৎপাদন ক্ষেত্রে লোকসানের সম্মুখীন হলে ফার্ম শিল্প থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ, উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। অন্যদিকে অতিরিক্ত মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে নতুন ফার্ম নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। অর্থাৎ, উৎপাদন নতুন করে শুরু করতে পারে।
৪. বাজারের অবস্থা সম্পর্কে ক্রেতা ও বিক্রেতারা পুরোপুরি অবহিত: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল পণ্যের একক, এর গুণগতমান এবং মূল্য সম্পর্কে ক্রেতা ও বিক্রেতা পুরোপুরি অবহিত থাকে। ক্রেতা পণ্যের বৈশিষ্ট্য বা মূল্য সম্পর্কে অবহিত থাকায় কোন বিক্রেতার পক্ষে বেশি মূল্য দাবি করা সম্ভব নয়। কারণ, বেশি মূল্য দাবি করলে ভোক্তা অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যাবে। বাজারের তথ্যাদি সম্পর্কে ভোক্তা সব সময় খোঁজখবর নেয় এবং তথ্য সংগ্রহ সম্পূর্ণরূপে খরচহীন ও স্বাধীন। আবার বিক্রেতাও ক্রেতাদের চাহিদা, রুচি এবং পণ্যের গুণাগুণ ও মূল্য সম্পর্কে পুরোপুরি জাত বলে কোন ক্রেতা নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা কম মূলা বিক্রেতাকে প্রদান করতে পারে না। এর ফলে এরূপ বাজারে লেনদেনের অনিশ্চয়তা শূন্যে নেমে আসে।
৫. সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় কোন উৎপাদিত দ্রব্য ক্রয়বিক্রয়ের উপর সরকারি কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অর্থাৎ শুল্ক, কর, ভরতুকি এবং রেশনিং ব্যবস্থার দ্বারা কোন দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে না। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে উৎপাদনকারী একজন মূল্য গ্রহীতা হিসেবে স্বীকৃতি। পায়। যদি সরকার উপরিউক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করে তবে স্বাধীনভাবে রাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারিত হবে না।
৬. উপকরণের পূর্ণ গতিশীলতা : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতিতে বিদ্যমান উৎপাদনশীল উপাদানসমূহ বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে অবাধে চলাচল করতে পারবে। অর্থাৎ, কোন শিল্পে মজুরি কম থাকলে যে শিল্পে মজুরি বেশি আসে সেখানে উপকরণ অবাধে চলে যেতে পারবে, এক্ষেত্রে কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ বিধিনিষেধ নেই। শ্রমিকগণ ভিন্ন ভিন্ন পেশায় স্থানান্তরিত হতে পারবে যা শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। কাঁচামালসমূহ কোন একটি ফার্মের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে না। যে কোন ফার্ম প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে তা ক্রয় করতে পারবে। এভাবে উপাদান মূল্যের মধ্যে সমতা বিধানের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর মাধ্যমে খরচ এর মধ্যে সমজাতীয়তার সম্ভাবনা নিহিত থাকে।
৭. উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মুনাফা সর্বোচ্চকরণ : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য থাকে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে ফার্ম সর্বনিম্ন ব্যয়ে দক্ষতার সাথে উৎপাদন পরিচালনা করে।
৮. পরিবহণ খরচ বিবেচনা বহির্ভূত : পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পরিবহণ খরচ বিবেচনায় আনা হয় না। পরিবহন খরচ থাকলে একই দ্রব্যের দাম বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন রকম হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বাজারের দূরত্বের ভিত্তিতে মূল্যের পার্থক্য পরিলক্ষিত হলে পূর্ণ প্রতিযোগিতায় নামের একত্বরূপ ব্যহত হয়। আর পরিবহণ খরচ বিবেচনায় না আনলে বিভিন্ন বাজারে দ্রব্যের মূল্য একই হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।