ইসলামি অর্থনীতির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

admin

 ভূমিকা :

ইসলামি অর্থনীতি পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেয়। এ অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ। তাই অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় ইসলামি । অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।


ইসলামি অর্থনীতির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


নিম্নে ইসলামি অর্থনীতির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হল : 

১. ইসলামি শরিয়ত :

ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালা ইসলামি শরিয়তের উপর নির্ভরশীল। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। সুতরাং, ইসলামি অর্থনীতিতে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ, ইসলামের মূল দর্শন ও রাসূল (স) এর হাদিসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয় ।


২. সম্পদের মালিকানা :

ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। তবে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে একমাত্র আল্লাহই বিশ্বের সমুদয় ধনসম্পদের মালিক। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তার আদেশ ও নিষেধের অনুবর্তী এসব সম্পদ ভোগ, দখল ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার নেওয়া হলেও এর অপব্যয়, অপচয় বা খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের অধিকার কোন ব্যক্তির নেই ।


৩. সম্পদের বণ্টন :

ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের বণ্টনের মূল লক্ষ্য হল ন্যায়নীতি ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। ইসলামে ধনী দরিদ্রের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক অসমতা দূরীকরণের লক্ষ্যে জাকাত, সাদকা, ফেতরা প্রভৃতির মাধ্যমে ধনীদের সম্পদ কমানো এবং তা গরিবের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে সম্পদের স্বাভাবিক ও ন্যায়ভিত্তিক প্রবাহ নিশ্চিত করাই হল ইসলামি অর্থনীতির বণ্টন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ।


৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা :

ইসলামি অর্থনীতির সাথে নৈতিক মূল্যবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করে কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সীমাহীন ভোগ সমাজে যেসব বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তি জীবনে যে স্বার্থপরতা ও আত্মচিন্তার জন্ম দেয় তা নির্মূল করার জন্য ইসলামি অর্থনীতিতে কতকগুলো জিনিসের উৎপাদন, ভোগ ও ব্যবহার হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।


৫. শ্রমের মর্যাদা :

শ্রমই যে কোন অর্থনৈতিক অধিকারের একমাত্র মানদণ্ড। তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থায় গুরুত্বসহকারে শ্রমের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতিতে নারীকেও শ্রমের বিনিময়ে ভোগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শ্রমের মর্যাদা।


৬. সামাজিক কল্যাণ :

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সমস্ত সম্পদ মানবকল্যাণে ব্যয় করার বিধান রয়েছে। জাকাত, সদকা, ওশর, ফিতরা প্রভৃতি ব্যয় দ্বারা রাজস্বনীতি পরিচালনা করলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে সামাজিক কল্যাণের পথও সুগম হবে। অর্থাৎ, ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমুদয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পদের কল্যাণমূলক ব্যবহার দ্বারা সামাজিক কল্যাণের জন্য পরিচালিত হবে।


৭. যাকাতের প্রবর্তন :

যাকাতের প্রবর্তন করা ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদের উপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। ইসলামি বিধান অনুযায়ী, “নেছাব পরিমাণ বা তার অধিক অর্থসম্পদ কারও কাছে এক বছর জমা থাকলে তাকে জাকাত প্রদান করতে হয়।” সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।


৮. সুদ হারাম :

ইসলামি অর্থনীতিতে সুদের অর্থ হল রিবা। কোন পরিশ্রম না করে বসে অর্থ শোষণ করা এবং লোকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বা ক্রয়বিক্রয়ের সময় ফাঁকি দিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার নাম হল সুদ বা রিবা। ইসলাম মানুষের অভাব ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে শোষণ করাকে সমর্থন করে না। তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে আর সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।


৯. বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা :

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় বায়তুল মাল হল রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা সরকারি তহবিল। ইসলামি রাষ্ট্রে বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করা একান্ত অপরিহার্য বিষয়। কেননা, কোন রাষ্ট্রই অর্থ বা সম্পদ ছাড়া চলতে পারে না। ইসলামি অর্থনীতিতে নাগরিকদের মঙ্গলের জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সেগুলো বাস্তবায়নের খরচ বায়তুল মাল থেকেই নির্বাহ করা হয় ।


১০. সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা :

বিশ্বের অন্যন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থাগুলো সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকিং পদ্ধতি পূর্ব নির্ধারিত সুদের স্থলে লাভ লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যেহেতু সুদ তারল্য ফাদ সৃষ্টি এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করা ছাড়াও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে, তাই ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থায় সুদের কোন স্থান নেই ।


১১. অপব্যয় ও বিলাসিতার সমর্থন নেই :

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় শরীয়াহ বিধিবিধান দ্বারা ভোগ কর্ম নিয়ন্ত্রিত। এজন্য এখানে অপচয় বা বিলাসিতাকে সমর্থন করা হয় না। আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবাধ্যতা, অন্যায় ও অনর্থক কাজে ধনসম্পদ ব্যয় করাকে অপব্যয় বলা হয়। আবার ইসলাম কৃপণতাকেও প্রশ্রয় দেয় না। এক্ষেত্রে অর্জিত আয়ের ব্যয় ও বণ্টন অবশ্যই উৎপাদনমুখী হতে হবে।


১২. জীবনের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনা :

ইসলামি অর্থব্যবস্থা মানবজীবনের কোন বিচ্ছিন্ন বা আংশিক ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করে না, বরং মানবজীবনের সমগ্র ক্ষেত্র এর আওতাভুক্ত। ইসলামি অর্থনীতিতে বলা হয় যে, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ তার নির্দেশমতো ব্যবহার করবে।


১৩. বৈধ উপার্জন :

ইসলামি অর্থনীতিতে বৈধ উপার্জনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় আদর্শ জীবন পদ্ধতিকে সমর্থন করা হয়েছে। তাই এ ব্যবস্থায় সুদ, ঘুস, মদ, জুয়া, চোরাকারবারি, কালোবাজারি, অতিরিক্ত মুনাফা প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ইসলামি অর্থব্যবস্থা হল একটি আদর্শ অর্থব্যবস্থা এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হল ইসলামি অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। বস্তুত ইসলামি অর্থনীতি ইসলামের মূল আদর্শ ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং ইসলামি শরীয়তের উপর ভিত্তি করে সকল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।




#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!