বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কি? বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে মনোবিজ্ঞান নিজেকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উন্নীত করেছে। মনোবিজ্ঞান আজ একটি বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে পরিগণিত। এ বিজ্ঞান মানুষের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, মনোবিজ্ঞানীগণ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আচরণের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে উপাত্ত সংগ্রহ করে এর বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন । ফলে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হচ্ছে।


বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কি বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা কর

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি :

বিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর দৃষ্টিভঙ্গি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বুঝায় পুরাতন জ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে না থেকে নিত্যনতুন বিষয়কে গ্রহণ করা। তত্ত্ব ও তথ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাকে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানীর থাকতে হবে। বিজ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে না, কারণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি ক্রমবর্ধমান। পারমাণবিক জগৎ সম্বন্ধে পদার্থ বিজ্ঞানে কিছুদিন আগে পর্যন্তও যেসব তত্ত্ব ও তথ্য জানা ছিল, আজ আমরা তার চেয়ে আরও অনেক বেশি জানি। সব জানা শেষ হয়েছে বা আর কিছু জানার নেই এ দৃষ্টিভঙ্গি অবৈজ্ঞানিক। আইনস্টাইনের মতবাদ কিছুদিন আগে পর্যন্তও পদার্থের শেষ কথা ছিল, কিন্তু আধুনিক গবেষণালব্ধ তথ্যের বলে আইনস্টাইনের মতবাদকে পরিমার্জিত ও সংশোধিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞানে আরও নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার হবে এটাই স্বাভাবিক।


আমরা মনোবিজ্ঞানে প্রাণীর আচরণ সম্বন্ধে আজ যেসব তত্ত্ব ও তথ্য জানি, কিছুদিন পরে নতুন গবেষণার ফলে সেগুলোতে আরও নতুন সংযোজন হবে সন্দেহ নেই। পুরাতন তথ্য ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানে নতুনের উদ্ভব হয়। সেজন্য পুরাতনকেই চিরন্তন মনে করে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টাকে বিজ্ঞান ঘৃণা করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য হল, ১. প্রগতিশীলতা ২. অনুসন্ধিৎসা এবং ৩. সন্দেহ প্রবণতা ।


মনোবিজ্ঞান আপাতঃলব্ধ জ্ঞানকে চিরন্তন বলে মনে করে না। নতুন নতুন তথ্য আহরণ করার জন্য সে সদা সচেষ্ট এবং অজানাকে জানার জন্য নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মনোবিজ্ঞানকে আত্মা বা মনের বিজ্ঞান বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে আত্মা বা মনকে বাদ দিয়ে আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়াকে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।


বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যাবলি :

'বিজ্ঞান' শব্দের আভিধানিক অর্থ হল 'বিশেষ জ্ঞান'। যে কোন বিশেষ শ্রেণীর বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে যথাযথ ও সুসংবদ্ধ জ্ঞানকে বলা হয় বিজ্ঞান । অর্থাৎ, সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত অবস্থায় কোন বস্তু বা ঘটনাকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তাই বিজ্ঞান। কোন বিষয় বিজ্ঞান কি না তা নির্ভর করে চারটি ঘটনা বা বিষয়ের উপর । যথা :


বিষয়বস্তু : সব বিজ্ঞানেরই একটি স্বীকার্য হল যে, বিজ্ঞান যে বস্তু বা ঘটনার অনুধ্যান করে তা নিয়মসাপেক্ষ । তাছাড়া বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা :

১. বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণযোগ্য হবে।

২. বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একে অপরের সাথে ভাষার সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।

৩. বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে প্রমাণযোগ্য হতে হবে।


মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হল আচরণ। মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ খুব ভালোভাবেই পূর্ণ করে। তাই বিষয়বস্তুর দিক থেকে মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যায়। 


বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি : বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তার গবেষণা পদ্ধতি, বিষয়বস্তু নয়। গবেষণায় যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসরণ করা হয় তাহলে তাকে বিজ্ঞান বলা যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কতকগুলো নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল :


১. কার্যকরী সংজ্ঞা :

যে বিষয়ের উপর অনুধ্যান করা হচ্ছে তা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা বা নির্দেশ করাই হচ্ছে কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান। যখন বৈজ্ঞানিক কোন বিষয়বস্তু সম্পর্কে গবেষণা করেন তখন তিনি উক্ত বিষয়ের একটি কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান না। মনোবিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় হচ্ছে প্রাণীর আচরণ। তিনি প্রাণীর বহুবিধ আচরণের মধ্যে যে আচরণটি গবেষণার জন্য করেন। কার্যকরী সংজ্ঞা ছাড়া গবেষণার বিষয়বস্তু অস্পষ্ট হয়ে পড়ে এবং উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোন দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় বেছে নেন তা সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন'। যেমন-মনোবিজ্ঞানী যদি ‘শিক্ষণের উপর বলীয়ানকারীর প্রভাব' সম্পর্কে গবেষণা করতে চান, তবে তাকে সর্বপ্রথম 'শিক্ষণ', 'বলীয়ানকারী' ইত্যাদি শব্দসমূহের কার্যকরী সংজ্ঞা দিতে হবে এবং উক্ত বিষয় তিনি কিভাবে পরিমাপ করবেন তা নির্দিষ্ট করতে হবে।


2.পর্যবেক্ষণের নিয়ন্ত্রণ :

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পর্যবেক্ষণ। বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণকে অবশ্যই সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। বিজ্ঞানী যখন কোন আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তিনি গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেই তা করে থাকেন। মনোবিজ্ঞানীর উদ্দেশ্য হল আচরণের ‘কার্যকারণ সম্পর্ক' আবিষ্কার করা। কিন্তু কোন আচরণের কার্যকারণ আবিষ্কার করতে গেলে পারিপার্শ্বিক উদ্দীপকসমূহকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। পরীক্ষক সাধারণত একটিমাত্র উদ্দীপক পরীক্ষণ পাত্রের উপরে প্রয়োগ ফেরেন এবং তার ফলাফল লক্ষ্য করেন। কিন্তু একটিমাত্র উদ্দীপক ছাড়া অন্যান্য উদ্দীপককে পরীক্ষণের বাইরে রাখেন। এর ফলে উদ্দীপকটির প্রয়োগে আচরণের কি ধরনের এবং কতটুকু পরিবর্তন ঘটছে, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন।


৩. পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তিতা :

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি বিশেষ দিক হল পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তিতা। বিজ্ঞানী কখনও একটি মাত্র পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হন না। মনোবিজ্ঞানী কোন একটি আচরণকে বারবার পর্যবেক্ষণ করেন। সুতরাং, আচরণটি এমন হতে হবে যেন এটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেসব ঘটনা একবার মাত্র ঘটে সেসব ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞানী বিশেষ আগ্রহী নন। পুনরাবৃত্তি ঘটে শুধুমাত্র এমন আচরণেরই কার্যকারণ আবিষ্কার করা সম্ভব। সেজন্য যেসব আচরণ বারবার ঘটে মনোবিজ্ঞানী সে ধরনের একটি আচরণকে পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করেন এবং লিপিবদ্ধ করেন।


বিজ্ঞানী যখন কোন পরীক্ষণ কার্য পরিচালনা করেন তখন একটি মাত্র পরীক্ষণের উপর নির্ভর করে তিনি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। বহুসংখ্যক পরীক্ষণের পুনরাবৃত্তি করে তবে কোন ফলাফল সম্পর্কে তিনি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেমন-একজন ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ‘কর্মব্যস্ত' সময়কে ব্যক্তি অবমূল্যায়ন করে। কিন্তু তা থেকে বিজ্ঞানী একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না। বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণ করেই শুধুমাত্র একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।


৪. সাধারণীকরণ :

বহুসংখ্যক পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যরাশিকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানী একটি সাধারণ সূত্রে উপনীত হন। যেমন- বিজ্ঞানী যদি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বহুসংখ্যক লোকের উপর লাল আলো ও নীল আলোর প্রতি প্রতিক্রিয়াকাল পর্যবেক্ষণ করেন এবং তিনি লক্ষ্য করেন যে, বেশিরভাগ পরীক্ষণেই লাল আলোর প্রতিক্রিয়াকাল নীল আলোর চেয়ে কম, তাহলে তিনি একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। মানুষের আচরণ সম্পর্কে এ ধরনের নিয়ম আবিষ্কার করাই হল মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য।


৫. যথার্থতা প্রমাণ :

যথার্থতা প্রমাণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ। বৈজ্ঞানিক তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রকাশ করলেই তা বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় না । পৃথিবীতে যে কোন বিজ্ঞানী একই বিষয়বস্তুকে নিয়ে ফলাফলের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য বারবার পরীক্ষা ও গবেষণা করতে পারেন। বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণামূলক নিবন্ধে তার সমস্যা, পরিবেশ এবং গবেষণামূলক পদ্ধতির উল্লেখ করে থাকেন। কাজেই কোন পরীক্ষক সে পরিবেশ সৃষ্টি করে সে বিশেষ সমস্যা নিয়ে সেসব বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে উক্ত পরীক্ষণটির ফলাফল মূল্যায়ন করে দেখতে পারেন ।


৬. সামঞ্জস্যকরণ :

যদি দু'টি ব্যাখ্যাধর্মী উক্তি পরস্পরবিরোধী হয়, তবে অন্তত এর একটি অসত্য প্রমাণিত হবে। সামঞ্জস্যকরণের মূলকথা হল, “যে উক্তির সপক্ষে প্রমাণসাপেক্ষ অনেক উক্তি পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে যে কোন ব্যাখ্যাধর্মী উক্তি না। হলেই মনের আড়াল হয়'। আবার এরূপ বলতেও শুনি যে, বিরহ ভালোবাসাকে গভীরতর করে'। ভালোবাসার গভীরতার দৃষ্টিতে এ দু'টি থাকে।” বিজ্ঞানী ব্যাখ্যাধর্মী উক্তির পরস্পর বিরোধিতা দূর করে থাকেন। যেমন- আমরা অনেক সময় বলে থাকি যে, 'চোখের আড়াল উক্তি পরস্পরবিরোধী। এ দু'টির একটি যদি ব্যাখ্যাধর্মী হয় তবে অন্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে।


উপসংহার :

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, কোন বিষয়বস্তু, গবেষণা পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারযোগ্যতার কথা বিবেচনা করে মনোবিজ্ঞানকে নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান বলতে পারি। কেননা বিজ্ঞানের যেসব নিয়ম, বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার সবগুলোই মনোবিজ্ঞানে দৃষ্ট হয় ।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!