চিকিৎসামূলক পদ্ধতি কি? চিকিৎসামূলক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।

admin

 ভূমিকা :

চিকিৎসামূলক পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের মানসিক ও প্রায়োগিক ক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি খুবই সহায়ক। যে কোন ধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তির চিকিৎসার্থে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে মানসিক রোগীর সংখ্যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সে তুলনায় মনোচিকিৎসক বা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ১৯৯৫ সালে বেক্সিমো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক এক জরিপ গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে শতকরা প্রায় চৌত্রিশ ভাগ লোক মানসিক রোগগ্রস্ত। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এটি একটি মারাত্মক সমস্যা। তাই বাংলাদেশে চিকিৎসামূলক পদ্ধতির ব্যাপক গবেষণা ও উন্নয়ন করা প্রয়োজন।


চিকিৎসামূলক পদ্ধতি কি? চিকিৎসামূলক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।

চিকিৎসামূলক পদ্ধতি :

চিকিৎসামূলক পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মানুষের আচরণ বা চালচলনের তারতম্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং ব্যক্তি কোন অবস্থায়, কি ধরনের আচরণ করছে, কেন করছে ইত্যাদি বিষয় গবেষণা করা। এছাড়া এ পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মানুষ স্বাভাবিক থেকে কিভাবে অস্বাভাবিক বা মানসিক ভারসাম্যহীন বা পাগল হিসেবে পরিণত হয়, তা নিয়ে গবেষণা করা এবং কিভাবে তাকে আবার স্বাভাবিক বা সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, তার সমাধান বের করা ।


সাধারণভাবে, চিকিৎসামূলক পদ্ধতি বলতে মানসিক ভারসাম্যহীন বা মানসিক রোগীদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। এ পদ্ধতিকে অনেকে কেস স্ট্যাডি পদ্ধতি হিসেবেও গণ্য করে। কেস স্ট্যাডির মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানীগণ রোগীর অতীত ও বর্তমান ইতিহাস, পরিবারের সাথে সম্পর্ক, সমাজের সাথে সম্পর্ক, চাকরির ক্ষেত্র, বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক, ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে অনুসন্ধান করে মানসিক রোগ নির্ণয় ও সমাধানের চেষ্টা করেন ।


সুতরাং, যে পদ্ধতির সাহায্যে মানসিক রোগীর স্নায়বিক ও শারীরিক দিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, মানসিক ও সামাজিক দিকের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন এবং নির্ণীত রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাকে চিকিৎসামূলক পদ্ধতি বা চিকিৎসামূলক মনোবিজ্ঞান বলা হয়।


চিকিৎসামূলক পদ্ধতির প্রকৃতি :

চিকিৎসামূলক পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল মানুষের আচরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। বিশেষ করে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের আচার আচরণ বিশ্লেষণ করা। মনোবিজ্ঞানীগণ মানসিক রোগ নির্ণয় করার জন্য কতকগুলো অভীক্ষা গ্রহণ করেন। যথা : ক. বুদ্ধির অভীক্ষা, খ. ব্যক্তিত্ব পরিমাপ অভীক্ষা, গ. এম.এম.পি.আই. অভীক্ষা, ६. রোরশাক ইঙ্কব্লট অভীক্ষা, ঙ. থেমিটিক এপারসেপশন অভীক্ষা, চ. উডওয়ার্থ পার্সনাল ডেটা সীট, ছ. বার্ণরয়টার ইনভেন্টরি ইত্যাদি। এ অভীক্ষাগুলো পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে মনোচিকিৎসকগণ মানসিক রোগ নির্ণয় করেন।


অবশ্য বর্তমানে মনোচিকিৎসামূলক পদ্ধতি জটিল আকার ধারণ করায় মনোবিজ্ঞানীগণ আরও নতুন নতুন অভীক্ষা ও পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। আধুনিককালে মানসিক রোগ নির্ণয়ে মনোবিজ্ঞানীগণ যেসব অভীক্ষা ও পদ্ধতি অবলম্বন করেন সেগুলো হল :

i সাক্ষাৎকার,

ii. প্রশ্নাবলি,

iii. ব্যক্তি ইতিহাস সংগ্রহ ও পর্যালোচনা,

iv. পরামর্শ,

v. মনোসমীক্ষণ,

vi. প্রতিফলন অভীক্ষা,

vii. প্ররোচিতকরণ,

viii. নাট্যাভিনয়,

ix. খেলাভিত্তিক চিকিৎসা,

x. বৃত্তিমূলক চিকিৎসা,

xi. শিক্ষামূলক চিকিৎসা,

xii. আচরণ চিকিৎসা

xilli, পারিবারিক চিকিৎসা ইত্যাদি।

চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীগণ মানসিক রোগীর গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী চিকিৎসা, পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে থাকেন । এছাড়া চিকিৎসামূলক পদ্ধতির উন্নয়ন সাধনের জন্য আরও নতুন নতুন অভীক্ষা বা পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালান ।


চিকিৎসামূলক পদ্ধতির মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। স্বাভাবিক চিকিৎসার মাধ্যমে সাধারণত এসব রোগী ভালো হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে মানসিক গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বা উপকারিতা : বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ রোগীগণ চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্টগণের নিকট যান। তাই চিকিৎসামূলক পদ্ধতি বা চিকিৎসামূলক মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে চিকিৎসামূলক পদ্ধতির গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হল :


১. রোগীর সমস্যা ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা :

মানসিক রোগীর সমস্যা ও আচরণ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য চিকিৎসামূলক পদ্ধতি অপরিহার্য। কেননা, এ পদ্ধতির সাহায্যে মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন প্রকার অভীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে রোগীর প্রকৃত সমস্যা ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করেন, যার ফলে রোগীর চিকিৎসা করতে সহজ ও সুবিধাজনক হয় এবং রোগীও খুব দ্রুত আরোগ্যলাভ করেন ।


২. রোগীর মধ্যকার গুরুতর ও জটিল অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ ও সমাধান নির্ণয় :

চিকিৎসামূলক পদ্ধতির সাহায্যে মনোবিজ্ঞানীগণ রোগীর মধ্যকার গুরুতর ও জটিল অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ নির্ণয় করেন। এক্ষেত্রে অবশ্য মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ধরনের অভীক্ষা গ্রহণ করেন, যেমন- ব্যক্তি ইতিহাস সংগ্রহ পদ্ধতি, নাট্যাভিনয় প্রভৃতি। গবেষণার মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানীগণ মানসিক রোগীর মধ্যকার অন্ত দ্বন্দ্বের সমাধান করার পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন। তাই চিকিৎসামূলক পদ্ধতি বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল ও সমস্যাগ্রস্ত দেশের রোগীদের জন্য একান্ত প্রয়োজন ।


৩. রোগীর অবাঞ্ছিত অভ্যাস পরিবর্তন :

চিকিৎসামূলক মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে সাইকিয়াট্রিস্টগণ রোগীর অবাঞ্ছিত অভ্যাস বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাধানের চেষ্টা করেন। এসব অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারলে রোগী সহজে সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে। তাই মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে মানসিক রোগীর অবাঞ্ছিত অভ্যাস পরিত্যাগ করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীগণ চিকিৎসামূলক বিভিন্ন ধরনের অভীক্ষা গ্রহণ করেন ।


৪. রোগীর নিজের এবং পৃথিবী সম্পর্কিত ত্রুটিপূর্ণ ধারণার পরিবর্তন :

মানসিক রোগী স্বাভাবিকভাবেই নিজের ও পৃথিবী সম্পর্কে বিভিন্ন খারাপ ধারণা পোষণ করেন। কেননা, এ সময় তার ভিতর কোন ধরনের বুদ্ধি, জ্ঞান থাকে না। চিকিৎসামূলক পদ্ধতির সাহায্যে মনোবিজ্ঞানীগণ রোগীর নিজের ও পৃথিবী সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ ধারণার পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অভীক্ষার দ্বারস্থ হন। যেমন— প্ররোচিতকরণ, মনোসমীক্ষণ, আচরণ চিকিৎসা ইত্যাদি। এসব অভীক্ষার মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানীগণ সহজে রোগীর মধ্যে স্বাভাবিকতা আনতে সক্ষম হন।


৫. মানসিক দক্ষতা উন্নয়ন :

চিকিৎসামূলক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে মানসিক রোগীর মানসিক দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টগণ রোগীকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ প্রদান করেন। যদি রোগী সে পরামর্শ অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তাহলে সহজে তার মানসিক বিকাশ ঘটে। অবশ্য এক্ষেত্রে রোগীর অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। তাছাড়া মনোবিজ্ঞানীগণ আরও বিভিন্ন অভীক্ষার মাধ্যমে রোগীর মানসিক দক্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করেন। সুতরাং, চিকিৎসামূলক মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকার্য।


৬. রোগীকে সম্পূর্ণ সত্তাতে পৌঁছানোর পথপ্রদর্শন :

মানসিক রোগীর ব্যক্তিসত্তার বিকাশকে পূর্ণ পরিণতি, সুদক্ষতা ও আত্মঙ্কুরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মনোবিজ্ঞানীগণ চিকিৎসামূলক অভীক্ষা গ্রহণ করেন, যার ফলে মানসিক রোগী সম্পূর্ণ  স্বাভাবিক সত্তাতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এজন্য অবশ্য চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীগণের অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসার ধরন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।



উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষ সবসময় তার পরিবেশের সাথে উপযোজনের ব বাপখাইয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু সবসময় মানুষ সুষ্ঠুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। আর মানুষ যখনই পরিবেশের সাে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারে না, তখনই তার মধ্যে মানসিক রোগ বা মনোবিকার দেখা দিতে পারে। চিকিৎসামূলক পদ্ধতি সাহায্যে উপাত্ত সংগ্রহ করে মনোবিজ্ঞানীগণ মানসিক রোগ নির্ণয় ও সমাধানের ব্যবস্থা করেন। সুতরাং একথা বলা যায়, মানসি রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসামূলক পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!