ম্যাকিয়াভেলির মতে শাসকের কি কি গুণাবলি থাকা উচিত? বর্ণনা কর ।

admin

ভূমিকা :

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত The prince গ্রন্থে শাসকের গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, A prince should combin both the qualities of a fox and a lion, অর্থাৎ শাসকের মধ্যে শৃগাল ও সিংহের সমন্বয় সাধন থাকা উচিত শাসককে শক্তিশালী, চতুর ও কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। নিম্নে শাসকের গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


ম্যাকিয়াভেলির মতে শাসকের কি কি গুণাবলি থাকা উচিত? বর্ণনা কর ।

শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য :

ম্যাকিয়াভেলি তার শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কতিপয় মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেছেন। নিম্নে তা বর্ণনা করা হল :


১. বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ : ম্যাকিয়াভেলির মতে রাষ্ট্রনায়ক বা শাসককে সর্বক্ষণ জনগণের বন্ধুত্ব অর্জনে নিয়োজিত থাকতে হবে। বিপদের দিনে জনগণই তার একমাত্র বন্ধু বা সহায়। তবে স্বার্থান্বেষী বা উচ্চভিলাষী অভিজাত সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতে বলেছেন। কেননা তার বিপদের দিনে সুযোগ পেলে তাকে গুপ্ত শত্রুর মত সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠবে।


২. রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ : একজন রাষ্ট্রনায়ককে তার শাসন। ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যে মুনি-ঋষির মত সাধু হতে হবে এমন নয়, কারণ তার করণীয় ও কৃতকর্মের একমাত্র মাপকাঠি হলো রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, যখন কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে, তখন কোনটি ন্যায়, কোনটি অন্যায় ইত্যাদি বিবেচনা করা চলবে না। সুতরাং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করার পন্থা ব্যতীত সবকিছুই বর্জন করতে হবে।


৩. মানব প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা : ম্যাকিয়াভেলি আরো বলেছেন, যখন কোনো শাসক শাসন করতে অগ্রসর হবে, তখন তাকে অবশ্যই মানব প্রকৃতি সম্পর্কে এ ধারণার উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে যথার্থ আইন প্রণয়ন করা, সফলতার সাথে শাসন করা কষ্টকর হবে। এ জন্য শাসককে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে যে, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা যে কোনোভাবেই হোক মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। কেননা ভালোবাসার মধ্য দিয়ে নয় বরং ভীতি প্রদর্শনই মানুষের বশীভূত করার একমাত্র পথ। তিনি আরো বলেছেন প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা, দয়া দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে মানুষকে কোনো দিন জয় করা যায় না। কেননা মানুষ সব সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ লোভ লালসায় চরিতার্থ করতে চায়। তাছাড়া শাসককে সব সময় মানুষের জীবন ও সম্পত্তি অগ্রাধিকার, নিরাপত্তা বিধানের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।


৪. শাসকের গুণাবলি : ম্যাকিয়াভেলি বলেন যে, শাসকের অবশ্যই সৎ গুণাবলি অর্জন করতে সচেষ্ট হতে হবে। ম্যাকিয়াভেলির The prince গ্রন্থের মূল লক্ষ্যই ছিল ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তিনি শাসকের মধ্যে শৃগাল ও সিংহের সমন্বয়ে বিষয়টির উপর জোর দেন। নিম্নে ম্যাকিয়াভেলির এ উক্তিটি আলোকপাত করা হলো :


৫. শাসক বিশ্বাসী হবেন : নৈতিক শাস্ত্রকে রাজনীতির সাথে তিনি মিলাতে চাননি বলে প্রস্তাব করেছেন। শাসক বিশ্বস্ত হবে এটা কোনো বাধ্যতামূলক নয়। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে তার মতামত হলো, মানুষ লোভী, হিংসুক, স্বার্থপর ইত্যাদি। এর মধ্যে অন্যায় বা অবিচার বলতে কিছু নেই। বরং শঠতার আশ্রয় নেয়াকে তিনি বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে অভিহিত করেন। তার মতে, A prudent ruter ought not to keep faith when by so doing it would be against his interests.


৬. ন্যায়পরায়ণ শাসক : ম্যাকিয়াভেলির মতে রাষ্ট্রনায়কদের পোশাক পরিচ্ছদ, আচার আচরণ এমন হবে যেন দেখলেই মনে হয় তিনি সৎ, চরিত্রবান, জনকল্যাণী, ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক ব্যক্তি। তবে উপরিউক্ত গুণাবলি তাকে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ | করতে হবে। এক কথায় রাষ্ট্রনায়কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমন হবে যে, তিনি যেখানে যেমন সেখানে তেমনি দেখা দিতে পারেন। তার মতে অনেক ন্যায়পরায়ণ শাসকরা রাষ্ট্রের যথেষ্ট কল্যাণ সাধন করা | সত্ত্বেও নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা ও ক্রমোন্নতি সাধন করেছেন এবং এতে শাসন ক্ষমতা আরো জোরদার হয়েছে।


৭. শাসকের উদ্দেশ্য : শাসকের উদ্দেশ্য হবে জনগণের কল্যান সাধন করা। আর তার জন্য শাসক কাজ করে যাবে। শাসক ঐক্য ও সংহতি এসবের উপর নজর দিবে। এগুলো হলো শাসকের অন্যতম দায়িত্ব যা তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। এগুলো অর্জনে ব্যর্থতা মানে শাসন অধিকার হারিয়ে ফেলা। আইনের প্রতি তার আনুগত্য ও নিষ্ঠা আছে প্রমাণ করা দরকার। সাধারণ অবস্থায় | তিনি আইনানুগ পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবেন।


৮. শাসক প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হবেন : স্বার্থ অর্জনের জন্য শাসক প্রয়োজনে নিঠুর হবেন। তবে এক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে। যদি এই নিষ্ঠুরতা জাতি ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে তাহালে মানক নিষ্ঠুরের পথ বেছে নিতে পারে। শাসক যদি নিষ্ঠুর না হয়। তাহলে বিশৃঙ্খলা এসে যেতে পারে। সেটি আবার রাষ্ট্রের পক্ষে আরও ক্ষতিকর। তবে নিষ্ঠুরতা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়।


১. শাসন কাজে দক্ষতা: প্রয়োজন দেশের জন্য একটা দক্ষ শাসক দরকার, তাই দেশ পরিচালনার জন্য দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। ম্যাকিয়াভেলির মতে দক্ষতা পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতার কোনো অবদান নেই। সুতরাং শাসক শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে এমন কোনো নির্দেশ জারি করা অযৌক্তিক।


১০. রাষ্ট্রের অস্তিত্ব: বড় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও জরুরি প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্যই ধর্ম ও নৈতিকতাকে তিনি গৌণ করে দেখেছেন। তিনি বলেন, Let the prince look to the maintenance of the state the means will always be deemed honourable and will receive general approbation'- ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন রাষ্ট্র যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে ব্যক্তি কখনো অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না।


১১. শাসকের চরিত্র: ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসকের চরিত্রে প্রধান দুটি বেশিষ্ট্য থাকা উচিত। যথা সৎ বা আইনি শক্তিসম্পন্ন এবং পাশবিক শক্তিসম্পন্ন। তার মতে, A prince should combine both the qualities of a fox and a lion' আধুনিক বিশ্বের শাসকবর্গের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারা অনুসারে কাজ করছে।


১২. দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ : ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন প্রথম শ্রেণির দেশপ্রেমিক। আর তাই তিনি বলেন যে, শাসকের মধ্যে এই দেশপ্রেম জাগ্রত থাকতে হবে। নয়ত কোনো শাসকের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়।


মূল্যায়ন :

ম্যাকিয়াভেলির এই সকল দিক মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, একজন আদর্শ শাসকের মধ্যে যে সকল গুণ থাকা দরকার তা তিনি বর্ণনা করে গেছেন। উপরিউক্ত গুণের যিনি অধিকারী হবেন, তিনিই উত্তম শাসক হতে পারবেন। মোটকথা, শাসকের মধ্যে শৃগাল ও সিংহের গুণাবলির সমন্বয় সাধিত হওয়া উচিত। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, শাসক হবেন শৃগালের ন্যায় ধূর্ত, সিংহের ন্যায় বলশালী।


উপসংহার :

ম্যাকিয়াভেলির মতে, প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা, নয়া দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে মানুষকে কোনো দিন জয় করা যায় না। কেননা মানুষ সব সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ লোভ লালসায় চরিতার্থ করতে চায়। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে তার মতামত হলো, মানুষ লোভী, হিংসুক, স্বার্থপর ইত্যাদি। এর মধ্যে অন্যায় বা অবিচার বলতে কিছু নেই।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!